ব্যাংকে তারল্য হ্রাসে- খেলাপি ঋণ আদায়ে গুরুত্ব দিন
সম্পাদকীয়: ড.আরিফুর রহমান: দেশে ব্যাংক খাতে টাকার প্রবাহ বা তারল্য হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। গত নয় মাসে এ খাতে তারল্য কমেছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, গত বছরের জুনের শেষে বা জুলাইয়ের শুরুতে ব্যাংকগুলোয় তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত মার্চে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকায়। বস্তুত গত জুনের পর থেকে তারল্যের নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, তারল্য কমার কারণগুলো হলো-করোনার পর হঠাৎ ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়া; আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি; গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা; আমানত, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া প্রভৃতি।
ব্যাংকে তারল্য বাড়ে-কমে, এটি স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। তবে সাম্প্রতিক তারল্য হ্রাসের বিষয়টি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় নন, এ গুজব তাদেরও স্পর্শ করেছে। আমরা জানি, তথ্য নিয়ন্ত্রণ বা তথ্য গোপনের প্রবণতা থেকেই গুজবের সূত্রপাত হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু গুজবের মাত্রাটি তীব্র ছিল, সেহেতু এর উৎস খুঁজে বের করা দরকার। ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট বাড়লে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে কোনো গ্রাহককে যাতে খালি হাতে ফেরত যেতে না হয়, সেদিকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দৃষ্টি দিতে হবে। কোনো গ্রাহক টাকা তুলতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হলে গুজবের ডালপালা আরও বাড়তে পারে।
ব্যাংক খাতে বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। ডলার সংকট, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি ব্যয়বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে ব্যাংকগুলোয় তারল্য কমতেই পারে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমে গেছে। ফলে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ। এর বিপরীতে আমদানি ব্যয়বৃদ্ধিতে ডলারের খরচ বেড়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আমদানি ব্যয় মেটাতে হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর উচিত তারল্য বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া। প্রবাসীরা যাতে হুন্ডি বা ব্যাংকবহির্ভূত চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে তা বৈধ পথে পাঠান, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থ পাচার রোধে আরও কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দেওয়া। আমরা লক্ষ করে আসছি, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণগ্রহীতাদের নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে এ ছাড়ের পরিধি আরও বেড়ে যায়। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত বৈশ্বিক মন্দায় আরও একদফা ছাড় দেওয়া হয়। স্বভাবতই এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতে। ছাড়ের এ প্রবণতা বন্ধ করে ব্যাংকগুলোর বরং ঋণ আদায়ে মনোনিবেশ করা উচিত। এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতিও রোধ করা জরুরি। মূলত অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ এবং সবকিছু খতিয়ে না দেখে বেপরোয়া ঋণ বিতরণের কারণেও ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে।