বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৩
প্রথম পাতা » আর্ন্তজাতিক | পরিবেশ ও জলবায়ু | শিরোনাম | সাবলিড » ফরাসি প্রেসিডেন্টের চীন সফর: রাশিয়া-বেইজিং কতটুকু দূরত্ব তৈরি হবে?
ফরাসি প্রেসিডেন্টের চীন সফর: রাশিয়া-বেইজিং কতটুকু দূরত্ব তৈরি হবে?
বিবিসি২৪নিউজ,আন্তর্জাতিক ডেস্ক: নতুন দফায় ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রথমবারের মত চীন সফরে গেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁঁ । বুধবার থেকে তার এই তিন দিনের সফর এমন সময় হচ্ছে যখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে বড়রকম ফাটল তৈরি হয়েছে।
আমেরিকার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইউরোপও বলছে রাশিয়ার প্রতি চীনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থনের কারণে ইউক্রেন যুদ্ধের সুরাহা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের কথা রুশ জ্বালানি আমদানি বাড়িয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে চীন পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
চীন অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো সামরিক জোটকে দায়ী করে এবং তারা বারবার জোর দিয়ে বলেছে এই যুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
চীনে ফ্রান্সের ব্যাপক অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ২০২২ সালে দুই দেশের বাণিজ্য প্রথমবারের মত ১০০ বিলিয়ন ইউরো ছাড়িয়ে গেছে যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। যে কারণে ৬০ জনেরও বেশি শীর্ষস্থানীয় ফরাসি কোম্পানির প্রতিনিধিরা ম্যাক্রোঁঁর সফরসঙ্গী হয়েছেন যাদের মধ্যে এয়ারবাস এবং জ্বালানি জায়ান্ট ইডিএফ এর প্রধান নির্বাহীরাও রয়েছেন।
কিন্তু বেইজিংয়ে যাওয়ার আগে এবং সেখানে পৌঁছে যে সব কথা ফরাসী প্রেসিডেন্টের মুখে শোনা গেছে তাতে পরিষ্কার যে তার সঙ্গে চীনা নেতাদের কথাবার্তায় ব্যবসা ছাড়াও ইউক্রেন যুদ্ধ প্রধান একটি আলোচ্য বিষয় হবে।
বেইজিং রওয়ানা হওয়ার আগে ম্যাক্রোঁঁ টেলিফোনে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে। হোয়াইট হাউজ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বলা হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে তারা কথা বলেছেন।
মজার ব্যাপার হলো ম্যাক্রোঁঁর সঙ্গে একইসময়ে বেইজিং গেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেইন।
চীন সফরের ক’দিন আগে ব্রাসলসে যেসব কথা যে ভাষায় মিজ ভন ডের লেইন বলেছেন তা নিয়ে চীনা কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ব্রাসেলসে ৩০শে মার্চ এক অনুষ্ঠানে চীনা প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে মিজ ভন ডের লেইন বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার এমন “অবৈধ আগ্রাসন” সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট শি মস্কোর সঙ্গে “নো লিমিট (সীমাহীন)” সম্পর্ক বজায় রাখছেন।
তিনি বলেন, “পুতিনের সঙ্গে চীন কেমন সম্পর্ক রাখবে, তার ওপর নির্ভর করবে ইইউ-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ।“
তার দুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতির প্রধান জোসেফ বোরেলও বলেন “আমরা চীনের কাছে স্পষ্ট করেছি (ইউক্রেনে) রাশিয়ার নৃশংসতা এবং যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তাদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করবে তাদের সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক।“
এসব কথা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় মিজ ফন ডের লেইন চীনা নেতাদের জন্য কঠোর কিছু বার্তা নিয়ে বেইজিং গেছেন যা তিনি সামনাসামনি তাদের দেবেন।
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপ চীনের কাছ থেকে কী ধরনের ভূমিকা দেখতে চায় সে কথা সম্ভবত ফন ডের লেইন নয়, বরঞ্চ প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁঁই চীনা নেতাদের কাছে বলবেন।
“গত কয়েক মাস ধরে ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট ব্রাসেলসে বসে, আমেরিকায় গিয়ে যে ভাষায় চীনের বিষোদগার করছেন, তা চীনারা একেবারেই পছন্দ করছে না। আমরা মনে হয় না চীনা শীর্ষ নেতৃত্ব তার কথা শুনতে চাইবেন,” বলেন কুয়ালালামপুরে মালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী।
“বরঞ্চ প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁঁ চীনাদের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য। তিনি কূটনীতিতে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন যেটা চীন পছন্দ করে। তিনি কী বলেন তা চীনা প্রেসিডেন্ট শুনবেন,” বলেন ড. আলী।
ইউক্রেন এবং বেইজিং-মস্কো সম্পর্ক নিয়ে কোনো কথায় যেন চীনা নেতারা ক্ষিপ্ত না হন সে ব্যাপারে ম্যাক্রোঁঁ যে সতর্ক তা তার বিভিন্ন কথাতে স্পষ্ট।
বেইজিং পৌঁছে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, যেই-ই ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করছে, তাকেই দুষ্কর্মের “সাগরেদ” হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
কিন্তু তার পরপরই বেইজিংয়েই সেখানকার ফরাসি নাগরিকদের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন ইউক্রেনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ফ্রান্স চীনকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে চায়।
তিনি ঐ অনুষ্ঠানে বলেন, “চীনের সঙ্গে কোনোভাবেই আমরা বিচ্ছেদ চাই না।“
বেইজিং রওয়ানা হওয়ার আগে ম্যাক্রোঁঁর অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “চীনই এখন একমাত্র দেশ যারা ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
সবচেয়ে বড় কথা, ইউক্রেন যুদ্ধের সুরাহা নিয়ে ম্যাক্রোঁঁ হয়তো আমেরিকার কাছ থেকে কিছু বার্তা নিয়ে বেইজিং গেছেন।
ড মাহমুদ আলী বলেন, “সফরের আগ মুহূর্তে বাইডেন এবং ম্যাক্রোঁঁ র মধ্যে কী নিয়ে কথা হয়েছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাক্রোঁঁ কি ওয়াশিংটনের কাছ থেকে কিছু বার্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? চীনের দেওয়া শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আমেরিকানরা কি কিছু ভাবছে? সন্দেহ নেই চীনা নেতারা তা জানতে উৎসুক থাকবেন।”
“চীনারা মনে করে ইউক্রেন সংকট রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার একটি পরোক্ষ (প্রক্সি) যুদ্ধ এবং তা কবে শেষ সে সিদ্ধান্ত শুধুই আমেরিকার। ফলে, আমেরিকানরা কী ভাবছে সেটা শুনতে চীনারা আগ্রহী হবে।“
আগামী দুদিনে ইউরোপীয় দুই নেতা বেইজিংয়ে বসে ঠিক কী বার্তা শি জিন পিংকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন?
প্যারিস ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ফাউন্ডেশন ফর স্ট্রাটেজিক রিসার্চের গবেষক আন্তোয়ান বোন্ডাজ মনে করেন ইউরোপীয় দুই নেতা প্রধানত চীনকে বলবেন কোনোভাবেই যেন রাশিয়াকে অস্ত্র না দেওয়া হয়।
“প্রকাশ্য বৈঠকে তারা চীনা নেতাদের বলবেন কোনোভাবেই যেন রাশিয়াকে অস্ত্র না দেওয়া হয়। গোপন বৈঠকে হয়তো নিষেধাজ্ঞার ভয়ও দেখানো হতে পারে,” বার্তা সংস্থা এএফপির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন মি বোন্ডাজ।
চীনের জবাব কী হতে পারে
ইউক্রেন বিষয়ে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চীনা নেতারা কী বলতে পারেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং ইইউ প্রেসিডেন্টকে?
কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে সফর শুরুর আগে চীনা দুই কূটনীতিকের দেওয়া সাক্ষাৎকারে।
দুদিন আগে ব্রাসলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনা দূত ফু কং দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসকে। ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে “কোনোভাবেই চীন রাশিয়ার পক্ষ নেয়নি।“
তাহলে কেন চীন এখনও রাশিয়ার নিন্দা করেনি? এই প্রশ্নে চীনা ঐ দূত বলেন, “কারণ ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতিরক্ষামুলক যুদ্ধ বলে যে দাবি রাশিয়া করে সেটি চীন অনুধাবন করে। চীন সরকার বোঝে এই সংকটের মূল কারণগুলো খুবই জটিল।“
প্যারিসে চীনা রাষ্ট্রদূত লু শে কদিন আগে ফরাসি একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন চীনের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক দিন দিন চটে যাচ্ছে এবং এর প্রধান কারণ, তার মতে, “যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা বাড়িয়ে চলেছে এবং পক্ষ নিতে ইউরোপকে বাধ্য করছে।“
রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও ইদানিং প্রকাশ্যে বলছে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে ইউরোপ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারাচ্ছে। তার ফলেই সম্পর্কে বিরোধ বাড়ছে, ইউক্রেনের মত সংকটের সমাধান করা যাচ্ছে না।
বেইজিংয়ে চীনা নেতাদের কাছ থেকে একই কথা শুনতে হতে পারে ম্যাক্রোঁঁ এবং উরসুলা ভন ডের লেইনকে।