রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রথম পাতা » জাতীয় | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » মোটরসাইকেল নীতিমালার’ খসড়া তৈরি করেছে সরকার,শহরে সর্বোচ্চ গতি হবে ৩০ কিলোমিটার!
মোটরসাইকেল নীতিমালার’ খসড়া তৈরি করেছে সরকার,শহরে সর্বোচ্চ গতি হবে ৩০ কিলোমিটার!
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটছে, এর বেশিরভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে যানটির বেপরোয়া গতিকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালার’ খসড়া তৈরি করেছে সরকার। এতে শহরের মধ্যে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে বা মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বাইক চালানো যাবে না বলেও বিধান রাখা হয়েছে।
এতে আরও প্রস্তাব রাখা হয়েছে, রাইড শেয়ারিংয়ের সময় চালককে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত পোশাক ও নির্দিষ্ট রঙের হেলমেট পরতে হবে। গর্ভবতী নারী, প্রবীণ ও ১২ বছরের কম বয়সী কাউকে মোটরসাইকেল আরোহী করা যাবে না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ছয় হাজার ৮২৯টি। এতে নিহত হন সাত হাজার ৭১৩ জন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী তিন হাজার ৯১ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণেই ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বেড়েছে বলেও জানায় সংগঠনটি।
কেন দুর্ঘটনা
‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালার’ খসড়ায় বলা হয়েছে– বেপরোয়া প্রতিযোগিতার মনোভাব, গতি বাড়ানোর প্রবণতা, মোটরসাইকেলের ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা না থাকা, আইন পালনে অনীহা, মোবাইল ফোন ব্যবহার ইত্যাদি কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হয়। সেজন্য মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস; মোটরসাইকেলের নিরাপদ ব্যবহার ও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ বাইক ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া এবং মোটরসাইকেল চালকের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
এসব লক্ষ্য অর্জনে দ্রুতগতির মোটরসাইকেলের (স্পোর্টি মোটরসাইকেল) ব্যবহার কমানো এবং অপেক্ষাকৃত কম গতির মোটরসাইকেল (স্কুটি মোটরসাইকেল) বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। এটি শিগগিরই অনুমোদন পেতে পারে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
কী কী করা যাবে না
তিন অধ্যায়ের নীতিমালার অষ্টম ধারায় ‘সাধারণ নির্দেশাবলী’তে বলা হয়েছে- মোটরসাইকেল চালানোর সময় ইয়ারফোন পরা যাবে না এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। শহরের মধ্যে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। রাইডশেয়ারিং সার্ভিসে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের চালককে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত পোশাক ও নির্দিষ্ট রঙের হেলমেট পরতে হবে। গর্ভবতী নারী, প্রবীণ ব্যক্তি এবং ১২ বছরের কম বয়সী কাউকে মোটরসাইকেল আরোহী করা যাবে না। ক্যারিয়ার ছাড়া অনিরাপদ ও ভারসাম্যহীনভাবে মোটরসাইকেলে মালামাল বহন করা যাবে না। যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এমন স্থানে মোটরসাইকেল পার্কিং করা যাবে না।
এছাড়া মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত হ্যান্ডবিল, লিফলেট, পোস্টার, স্টিকার প্রস্তুত করে বিতরণের ব্যবস্থা করবে। তারা সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার করবে। এ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়মিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।
নীতিমালার ৬ নম্বর ধারায় ‘মোটরসাইকেল চলাচলের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে’ বলা হয়েছে- হালনাগাদ বৈধ কাগজপত্র (ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ট্যাক্স-টোকেন ইত্যাদি) এবং রেট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বরপ্লেট ও আরএফআইডি ট্যাগ ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো যাবে না; মোটরসাইকেল চালানোর সময় চালক ও আরোহী উভয়কেই সঠিকভাবে বিএসটিআই অনুমোদিত হেলমেট পরতে হবে; মহাসড়কে সর্বনিম্ন ১২৬ সিসি ইঞ্জিন বা সমতুলা ক্ষমতার (’ল’ সিরিজ) মোটরাইকেল চলাচল করতে পারবে অর্থাৎ মহাসড়কে ১২৬ সিসি ইঞ্জিন বা সমতু্যে ক্ষমতার চেয়ে কম ক্ষমতার কোনও মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।
মহাসড়কে চলাচলের জন্য মোটরসাইকেলে এবিএস (অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম) থাকতে হবে। মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানোর সময় চালক কোনও আরোহী বহন করতে পারবে না। চালককে নিরাপত্তা সরঞ্জাম (চেস্ট গার্ড, নি গার্ড, এলবো গার্ড, গোড়ালি ঢাকা জুতা বা কেডস, সম্পূর্ণ আঙুল ঢাকা গ্লাভস এবং ফুলপ্যান্ট, ফুলশার্ট) ব্যবহার করতে হবে। ঈদুলফিতর, ঈদুল আযহা, দূর্গাপূজা ইত্যাদি উৎসব-পার্বনের আগে ও পরে মোট ১০ দিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না।
এতে আরও বলা হয়েছে– মোটরসাইকেল বাম লেনে চালাতে হবে; ফুটপাতে চালানো যাবে না; বৃষ্টির সময় অতি সহজে থামানো যায় এমন নিয়ন্ত্রণ উপযোগী ধীরগতিতে মোটরসাইকেল চালাতে হবে; মোটরসাইকেল চালানোর সময় হঠাৎ গতি বৃদ্ধি করা, থামানো বা দ্রুত মোড় নেওয়া যাবে না; কুয়াশায় লো-বিম বা ডিপার জ্বালিয়ে সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ উপযোগী ধীরগতিতে মোটরসাইকেল চালাতে হবে। দৃষ্টিসীমা বেশি মাত্রায় কমে গেলে বা একেবারেই দেখা না গেলে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করতে হবে; মোটরসাইকেল চাোনোর সময় নির্ধারিত গতিসীমা মেনে চলতে হবে; রাতে মোটরসাইকেল চালালে রেট্রোরিফ্লেক্টিভ জ্যাকেট ব্যবহার করতে হবে; মোটরসাইকেল চালানোর সময় ফার্স্ট এইড কিট বহন করতে হবে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
খসড়া নীতিমালাটির বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নীতিমালটি এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর এটি চূড়ান্ত করা হবে। ফলে নীতিমালার বিভিন্ন ধারা-উপধারায় পরিবর্তন আসতে পারে।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, নীতিমালাটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমবে, এটা ঠিক। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, সরকার ভালো ভালো কথা বলে নীতিমালা করে। কিন্তু সেগুলো হয় আলোর মুখ দেখে না, নয় ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না আনতে পারলে শুধু মোটরসাইকেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে অবস্থার উন্নতি সম্ভব হবে না।
নীতিমালায় ‘কিছু ভালো দিক যেমন রয়েছে, তেমনই অনেকগুলো অযৌক্তিক বিষয় আছে’ উল্লেখ করে তিনি বলছেন, এটি বাস্তবায়নে নজরদারি কাড়াতে হবে। বিশেষ করে রাতের বেলায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। তা বন্ধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নিরাপদ সড়ক আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ ঘোষণার পরও সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল এখনও থামেনি, বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাত বছরে ৩৭ হাজার ৪২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১ হাজার ৬৬৫ জন নিহত এবং এক লাখ ৩৯৭ জন আহত হয়েছেন। গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত হয়েছেন।
মোটরসাইলজনিত দুর্ঘটনা ও হতাহতের লাগাম টানতে রোড সেফটির নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মোটরসাইলের সঙ্গে গতির এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। যানজট থেকে বাঁচতে, দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে এই বাহনে ছুটে চলছে অনেকে। বিভিন্ন কোম্পানি রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যাত্রী সেবা দিচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগত বাইক ব্যবহার করছেন। মূলত গণপরিবহনের অবস্থাপনা ও বিশঙ্খলার কারণে মানুষ বাইকমুখী হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে।
তারা বলছেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বাইক কোম্পানিগুলোর বেপরোয়া গতিরোধের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করা উচিত। সড়কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। মোটরসাইকেলের কেনাবেচা থেকে করে রাস্তায় চলাচলের প্রতিটি পর্যায়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে। এসব ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।