বুধবার, ২৩ মার্চ ২০২২
প্রথম পাতা » জীবনযাপন | জেলার খবর | পরিবেশ ও জলবায়ু | শিরোনাম | সাবলিড » পার্বত্য জেলাগুলোতে খাবার পানির তীব্র সংকট
পার্বত্য জেলাগুলোতে খাবার পানির তীব্র সংকট
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশের পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে এখনও ৩৪ শতাংশ মানুষ পাচ্ছেন না সুপেয় পানি। বিশেষ করে শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। কাপ্তাই লেকের পানি শুকিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও গত সেপ্টেম্বর থেকে বৃষ্টি না হওয়ার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পাহাড়ি গ্রামগুলো ঝিরি বা ছড়ার পানির ওপর নির্ভরশীলতার ফলে জেলার প্রতিটি উপজেলায় এখন বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা সুপেয় পানির এই সংকট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলো মূলত প্রাকৃতিক ছড়া, ঝিরি ও কুয়ার পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব জায়গায় পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে খাওয়ার পানির জন্য ওসব গ্রামবাসীকে দূর থেকে পায়ে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় কুয়ার পানি পান করে বিভিন্ন এলাকার মানুষ নানা রোগে ভুগছেন। প্রতিবছর পানিবাহিত রোগে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। তবে এ ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেই।স্থানীয়দের মতে, জেলার দুর্গম উপজেলাগুলোতে শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে তীব্র পানি সংকট দেখা দেয়। এতে পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস করা মানুষকে কয়েক ফুট নিচে নেমে পানি সংগ্রহ করতে হয়। আবার বর্ষা মৌসুমে কুয়াগুলোতে ময়লা পানি প্রবেশ করায় তখন সুপেয় পানির সংকট তীব্র হয়। সেসময়ে বৃষ্টির পানিই একমাত্র ভরসা এসব এলাকার মানুষের। আবার এসব এলাকায় পাথরের সংখ্যা বেশি হওয়ায় গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে পানির সংকট নিরসনে বড় আকারের কুয়া তৈরি এবং বর্ষায় এসব কুয়ায় ময়লা যাতে প্রবেশ না করে সে ব্যবস্থা করার দাবি স্থানীয়দের। একই সঙ্গে সেসব কুয়া থেকে বিভিন্ন এলাকায় পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহ করা হলে পানির সংকট কিছুটা লাঘব হবে বলে মনে করছেন দুর্গম এলাকার মানুষজন।
২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুসারে, রাঙামাটির জনসংখ্যা ছয় লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন। রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশের। দুর্গম এলাকাগুলোতে মাটির নিচে পাথর পড়ায় গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না। তবে নির্বিচারে বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধনের কারণে ক্রমশ পানির উৎস হারাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।
অপরদিকে, কাপ্তাই হ্রদের পানি পান দিন দিন অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এতে কুয়া, ঝিরি ও ঝরনার দূষিত পানি পানের কারণে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে স্থানীয়রা।
জুরাছড়ি উপজেলার দুর্গম মৈদং ইউনিয়নের ভুয়াতলীছড়া গ্রামে ১৫টি পাহাড়ি পরিবারের বসবাস। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাথুরে হওয়ায় এই এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হয়নি। তাই একমাত্র পানির উৎস হিসেবে কুয়ার পানির পান করে আসছেন গ্রামের পরিবারগুলো। তবে কুয়া পাহাড় থেকে নিচু এলাকা হওয়ায় ৪০০ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে পানির সংগ্রহ করেন তারা। বর্ষাকালে ছড়া ও কুয়া পানি ঘোলাটে ও ময়লা হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে।
জুরাছড়ি উপজেলার মৈদং ইউনিয়নের বাসিন্দা সুমন্ত চাকমা বলেন, শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে প্রচুর খাবার পানি সংকট দেখা দেয়। অনেক দূর থেকে আমাদের খাবার পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়। আর বর্ষায় কুয়ার পানি ময়লা পড়ে নষ্ট হওয়ায় তখন একমাত্র ভরসা বৃষ্টির পানি।
জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার চাকমা বলেন, আমাদের এলাকায় বিশেষ করে মৈদং, দুমদুম্যা ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি খাবার পানি সংকট দেখা যায় এই মৌসুমে। তবে কিছু কিছু জায়গায় নলকূপ বসানো হচ্ছে।
আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় ও রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজেলার দুর্গম ইউনিয়ন সাজেকের ৮০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভোগেন সারা বছর। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা নয়ন বলেন, সাজেকে সারা বছরই সুপেয় পানির সংকট থাকে। তবে এবছর অন্যান্য বছরের চেয়ে সংকট বেশি। আমার ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাটেলিং, লংকর, শিয়ালদহ ও তুইথুইসহ বেশি কয়েকটি এলাকায় সুপেয় পানির জন্য বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে এসব এলাকার মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ঝিরি ও ঝরনাগুলো আগে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি ও ঝরনার পানি শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায় পানির উৎস ঝিরি ও ঝরনা এবং কুয়া। কিন্তু পাহাড়ে এখন নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে; পানির উৎস কমছে। কারণ গাছপালা না থাকলে তো পাহাড়ে পানি পাওয়া যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সুপেয় পানির সংকট সমাধানে পাহাড়ের ভৌগোলিক বিষয়টি মাথায় সংশ্লিষ্টদের গবেষণার প্রয়োজন।
রাঙামাটি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে এটি সত্য। ভৌগোলিক কারণে সমতলের মতো এখানে প্রকল্প গ্রহণ করে সুপেয় পানির সংকট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পক্ষ থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন সাজেকসহ দুর্গম এলাকাগুলোতে পাহাড়ি ঝিরি, ঝরনা থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানির সুব্যবস্থা করার জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট অনেক কমে আসবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের দায়িত্বে থাকা রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য বিপুল ত্রিপুরা বলেন, রাঙামাটি জেলায় সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ৪৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাঠিয়েছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বরাদ্দ পাওয়া গেলে আশা করছি, সুপেয় পানির আর সংকট থাকবে না।