ঢাকায় জলজটে নগরবাসীর দুর্ভোগ
বিবিসি২৪নিউজ, বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকাঃ ঢাকায় বছরের প্রথম ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় অনেক এলাকার রাস্তাঘাট। বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা—এটাই যেন রাজধানীবাসীর নিয়তি। এমন পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে নানা উদ্যোগ নেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ওয়াসার কাছ থেকে খাল, নর্দমা, বক্স কালভার্ট ও পাম্পিং স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ নেয় নিজেদের হাতে। চালানো হয় পরিচ্ছন্নতা অভিযান। কিন্তু মৌসুমের প্রথম পরীক্ষায় ‘পুরোপুরি পাস’ করতে পারেনি দুই সিটি।
অবশ্য দুই সিটির উদ্যোগ সত্ত্বেও ভারী বৃষ্টিতে এবারও জলাবদ্ধতা হতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন নগরবিদেরা। তাঁরা বলছেন, কাজের কিছু সুফল পাওয়া গেছে। গতকাল অনেক জায়গা থেকে অল্প সময়ে পানি নেমে গেছে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তাঁরা জনসম্পৃক্ত পরিকল্পিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
গতকাল সকাল ৬টায় শুরু হয় বৃষ্টি। চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, এ সময় বৃষ্টি হয়েছে ৮৫ মিলিমিটার। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আরও ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার এই বৃষ্টি ছিল গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৭ সালের ১২ জুন রাজধানীতে ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।
গতকালের বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। জলজটের কারণে কয়েকটি সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় অফিসগামী লোকজনকে। তাঁদের একজন সাজেদা আক্তার। তাঁর বাসা মিরপুরে। সকাল ৮টায় মতিঝিলের কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন তিনি। ‘কালশী রোডে গিয়েই দেখি সড়কে কোমরসমান পানি। এর মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়ক তলিয়ে গেছে। মিরপুর ১০ থেকে মিরপুর ১৪ নম্বরের সড়কেরও একই অবস্থা।’ বলেন সাজেদা।
সাজেদার মতো যাঁরা জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়েছেন, তাঁদের পড়তে হয়েছে এমন পরিস্থিতিতে। পূর্ব শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বললেন, বাসা থেকে নেমে দেখি সড়কে হাঁটুপানি। পূর্ব শেওড়াপাড়ায় এই স্থায়ী বাসিন্দা জানান, এক যুগেরও বেশি সময়ে তাঁর বাসার সামনে এত পানি জমতে দেখেননি তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোর মতো গতকালও মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, রোকেয়া সরণি, দারুস সালাম রোড, শ্যামলী, ধানমন্ডি ২৭, গ্রিন রোড পানিতে তলিয়ে গেছে। নিউ এলিফ্যান্ট রোড, কালশী, কমলাপুর, রাজারবাগ, রামপুরা, খিলক্ষেত, মহাখালী, কাকলী, গুলশান–বাড্ডা লিংক রোডের কোথাও পানির পরিমাণ ছিল হাঁটুসমান, কোথাও প্রায় কোমরসমান। সড়ক তলিয়ে যাওয়ার কারণে সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল কম।
মিরপুর থেকে সদরঘাটগামী একটি একটি বাসের চালক মোহাম্মদ রায়হান বলেন, মিরপুর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়কে মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলেও এখনো সড়ক ঠিক হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় গর্ত রয়ে গেছে। ঝুঁকি নিয়েই পানি মাড়িয়ে গাড়ি চালিয়েছেন তিনি।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ওয়াসার কাছ থেকে খাল, নর্দমা ও পাম্পস্টেশনের দায়িত্ব নেয় ঢাকার দুই সিটি।
জলাবদ্ধতা সহনীয় মাত্রায় আনতে আরও দুই বছর
গতকালের জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘যেসব জায়গায় জলজটের সৃষ্টি হয়েছে, আমরা সেসব স্থানকে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রমে প্রাধিকার দেব এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতাকে একটি সহনীয় মাত্রায় আনতে সক্ষম হব।’
আর ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য প্রথমবারের মতো শিক্ষা। কোথায় কোথায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে, এটা নিয়ে আমরা জরুরি সভায় বসব। আসন্ন বর্ষায় কীভাবে নগরবাসীকে সুফল দিতে পারি, এই নিয়ে আমরা স্বল্প সময়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করব।’
‘জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রথম পরীক্ষায় দুই সিটি করপোরেশন আংশিক পাস করেছে’—এমন মন্তব্য করেছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। ‘আংশিক পাস’ বলার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মাত্র কয়েক মাস আগেই তারা এই দায়িত্ব পেয়েছে। এই নগরবিদ আরও বলেন, গতকালের বৃষ্টিতে দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা গেছে। এটা প্রমাণিত অনেক জায়গা পানি অল্প সময়ে নেমে গেছে। করপোরেশন বলছে, তারা সমস্যা চিহ্নিত করেছে। এর সমাধান–যাত্রা যে শুরু হয়েছে, তাই প্রমাণ হয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটির উদ্যোগ পর্যাপ্ত ছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বল্প সময়ে দুই সিটি যা করেছে, তা সন্তোষজনক। তবে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ময়লা হুট করে পরিষ্কার করা সম্ভব না। তাই পুরোপুরিভাবে এই কাজ শেষ করতে সময় লাগবে।
ভারী বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন এই নগরবিদ। সম্প্রতি তিনি বলেছিলেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করলেই যে জলাবদ্ধতা হবে না, এটা বলা যাবে না। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। অতিবৃষ্টি হলে এবারও কয়েকটি স্থানে জলাবদ্ধতা হবে।’
যা করছে ঢাকার দুই সিটি
ঢাকার দুই সিটির দেওয়া তথ্য বলছে, দক্ষিণ সিটিতে বর্তমানে আছে ৯৯৯ কিলোমিটার নর্দমা। এ ছাড়া বক্স কালভার্ট আছে ৬ কিলোমিটারের মতো। আর খাল আছে পাঁচটি। অন্যদিকে উত্তর সিটিতে নর্দমা আছে ১ হাজার ৩৭০ কিলোমিটার। ওয়াসার কাছ থেকে সংস্থাটি খাল পেয়েছে ২১টি।
ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার এক দিন পর থেকেই বক্স কালভার্টগুলো পরিষ্কারের কাজ শুরু করে দক্ষিণ সিটি। এরপর পর্যায়ক্রমে জিরানি, মান্ডা, কালুনগর, কাজলা ও শ্যামপুর খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ ও দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে সংস্থাটি। প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, এমন ২৫টি জায়গা চিহ্নিত করে প্রায় ১০৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে বাস্তবায়নের কাজ হাত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নালার উৎসমূল থেকে বহির্মুখ পর্যন্ত বৃষ্টির পানিপ্রবাহ সচল এবং বর্ষা মৌসুমে পাইপ নর্দমা ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার রাখতে ওয়ার্ডভিত্তিক আরও ৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর ভেতর জমে থাকা পানি ঢাকার চারপাশের নদ-নদীতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম পাম্পহাউস। ওয়াসার কাছ থেকে দুটি পাম্পস্টেশনের দায়িত্ব পেয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, ওয়াসার কাছ থেকে পাওয়া দুটি পাম্পস্টেশনই অচল ছিল। এগুলো সচল করার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে কমলাপুর পাম্পস্টেশনে তিনটি মেশিনের মধ্যে দুটি এবং দোলাইরপাড়ে তিনটির মধ্যে একটি পাম্প মেশিন সচল করা হয়েছে। আগামী জুলাই নাগাদ বাকি মেশিনগুলো সচল করার চেষ্টা চলছে।
বিজ্ঞাপন
জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে দুই প্রক্রিয়ায় কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি। এর মধ্যে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে খাল ও নর্দমা পরিষ্কারের কাজ করছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। গত ৪ জানুয়ারি থেকে ২ মে পর্যন্ত ২৯টি খাল থেকে ১৭ হাজার ৩৪০ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। আর প্রকৌশল বিভাগ পাম্পহাউস সচল করা এবং জলাবদ্ধতা বেশি হয় এমন জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে সংস্কারকাজ করছে।
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খালগুলো বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন সংস্থার প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এম সাইদুর রহমান। ২৯টি খাল থেকে বর্জ্য অপসারণে এ পর্যন্ত ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।
সামান্য বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, এমন পাঁচটি জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে পাইপলাইনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছে ঢাকা উত্তর। সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, এর মধ্যে বিজয় সরণি, মগবাজারের মধুবাগ, বিমানবন্দর থেকে কাকলি ও সংসদ ভবনের পাশে অবস্থিত খেজুরবাগান এলাকায় কাজ শেষ হয়েছে। এই কাজে সংস্থাটির অন্তত ৫০ কোটি টাকা ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।