বুধবার, ১২ মে ২০২১
প্রথম পাতা » সম্পাদকীয় | সাহিত্য ও সংস্কৃতি » একটি ঈদগাহের বোবা কান্না ও কিছু কথা!
একটি ঈদগাহের বোবা কান্না ও কিছু কথা!
এডঃজিয়াউল হক মৃধাঃ
বৃটিশ ভারতের বিখ্যাত গ্রাম কালিকচ্ছ গ্রাম-আমার বাস। যে গ্রামে একেশ্বরবাদী মহা সাধক আনন্দ স্বামী,মহা বিপ্লবী উল্লাসকর দও সহ অসংখ্য কৃতি পুরুষ মহিলার জন্ম।আমার মরহুম পিতা প্রায় ষাট বছর আগে নোয়াগাঁও থেকে কালীকচ্ছ এসে বসতি স্থাপন করে।নোয়াগাঁও গ্রামে জন্ম বিধায় এ গ্রামের সাথে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সামাজিক এবং পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয় এমনকি আমার পিতা মাতাকে ও নোয়াগাঁও গ্রামে পারিবারিক গোরস্থানে সমাহিত করেছি।জন্ম ভিটির সাথে যোগাযোগ থাকার ফলে ভিন্ন ইউনিয়নের ভিন্ন গ্রাম হওয়া স্বত্ত্বেও নোয়াগাঁও ইউনিয়ন ইসলামাবাদ ঈদগাহ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি দেড় যুগ ধরে।আমার পিতাও আমৃত্যু ঈদগাহ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঈদগাহ প্রসঙ্গে এত কথা বলছি এ জন্য যে লোকে বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে নোয়াগাঁও ইউনিয়ন ঈদগাহ ময়দানই নাকি সবচেয়ে বড় ঈদগাহ।ঈদগাহটি শতাব্দী প্রাচীন নোয়াগাঁও গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে খোলামেলা জায়গায় ঈদগাহটি অবস্থিত। চারদিকে ফসলের মাঠ।ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা এই ঈদগাহ ময়দান।ঈদগাহের পূর্ব দিকের অনুমান ৬০ বছরের প্রাচীন একটা বট গাছ কালের সাক্ষী হয়ে চারদিকে ডাল-পালা মেলে একটা দর্শনীয় বৃক্ষে পরিনত হয়েছে এবং বৃক্ষটি এতই বিস্তৃত যে পুরো মাঠের এক চতুর্থাংশ স্থানে মুসল্লীদের ছায়াদানে সক্ষম।তাছাড়া মাঠে আরো কয়েকটি ছায়াদানকারী বৃক্ষ লাগানো হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে।মাঠটি চারদিকে প্রাচীর ঘেরা পশ্চিম দিকে বৃহৎ গম্ভুজ । মাঠটির পূর্ব দিকে ২ একর আয়তন বিশিষ্ট বিশাল পুকুর। ঘাসে ঢাকা মাঠটিকে মনে হয় সবুজ গালিচায় ঢাকা। সব মিলিয়ে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষন করে এ মাঠটি।বট বৃক্ষটিকে দেখতে এবং মাঠটির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন বহু লোকের আনাগোনা হয় এই মাঠটিতে। সময়ে সুযোগে আমিও পড়ন্ত বিকেলে ঈদগাহ মাঠে যাই ক্ষণিকের আত্নার শান্তির জন্য- উদার প্রকৃতির কাছে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সমর্পন করার জন্য। বাড়তি বিষয় হলো মাঠের উওর দিকে ছোট্ট একটা টিলায় চিরনিদ্রায় শায়িত আমার গল্প বলা দাদী, যেখানে গেলে আমি আমার শৈশব,কৈশোর এবং যৌবনের সূচনালগ্নের সোনালী দিন গুলো খোঁজে পাই।দিন তিনেক আগে ঈদগাহ মাঠে গিয়েছিলাম মাঠের অবস্থা দেখতে আর ঈদের নামাজ যদি মাঠে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে মাঠে কি কি সংস্কার ও উন্নয়ন প্রয়োজন তা অবলোকন করতে।আমার সাথে ঈদগাহ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নোয়াগাঁও শেখ আশরাফ বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক মৃধা,সহ-সভাপতি ব্যাংকার ফরিদ উদ্দিন মৃধা,আলী নেওয়াজ,জাকির হোসেন ধল্যা-তেরকান্দা গ্রামের মাজিদ,গাজী,মোবারকসহ অনেকেই ছিল।আমরা মাঠে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে পার্শ্ববর্তী পাড়া মহল্লা থেকে অনেক লোক জড়ো হল ঈদগাহতে।সকলেরই এক প্রশ্ন এ বছরও কি আমরা ঈদগাহতে ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে পারব না? কি জবাব দেব ভেবে পাচ্ছি না। মাঠটির খ্যাতির কারণে শুধু নোয়াগাঁও ইউনিয়নই নয় দূরদূরান্ত থেকেও বহু মুসল্লী ঈদ জামাতে শরীক হয়।বাহির থেকে লোকজন আসার কারণ হলো এই ঈদগাহের জন্মলগ্ন থেকে ইমাম হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারা খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব।প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নামাজ পড়িয়েছেন সাবেক জজ”মানব ধর্ম” গ্রন্থের লেখক আলহাজ্ব ফজলুল করিম তিনি তখন ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মুন্সেফ ছিলেন তারপর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বড় হুজুর হিসেবে খ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা হয়রত সিরাজুল ইসলাম, এক হবিগঞ্জ সাহিত্যমনা আলেম মওলানা তাজুল ইসলাম। সবশেষে যিনি ইমাম ছিলেন তিনি হযরত মওলানা হাফেজ তোফাজ্জল হক হবিগঞ্জী ।ধর্মীয় বিষয়ে গভীর পান্ডিত্য ছিল তাঁর।মাঠের আকর্ষনে,ইমাম গণের আকর্ষনে নানা স্থানের লোকজন জড়ো হত ঈদগাহে।ঈদের নামায ঈদগাহ ময়দানে পড়ার গুরুত্বই আলাদা,নিজ গ্রাম বা মহল্লা পার্শ্ববর্তী গ্রাম তথা নানা স্থানের মানুষের মিলনমেলা ঈদগাহ ময়দান।ঈদগাহে মিলিত হয়ে পরষ্পরের ভাবের আদান প্রদান, নতুন প্রজন্মের সাথে পরিচিতি সর্বোপরি মানুষে মানুষে একটা ভালবাসা সৃষ্টি এবং পারস্পরিক ঐক্যের স্থান ঈদগাহ ময়দান।আর ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে প্রতিটি ঈদগাহ ময়দান পবিত্র আরাফা ময়দানের ক্ষুদ্র সংস্করণ।আমরা জানি স্বর্গচ্যুত আদি মাতা হাওয়া এবং পিতা আদম আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে বেহেশত থেকে বহিস্কৃত হয়ে বছরের পর বছর পরস্পরকে খুজতে খুজতে ৩’শ বছর পর পবিত্র আরাফা নামক প্রান্তরে পরস্পর মিলিত হয়েছিলেন।মানব জাতির আদি পিতা এবং আদি মাতার মহা মিলনের স্থান হল পবিত্র আরাফা ময়দান। আরাফাতে দু’টি মানব-মানবী পরস্পরকে কাছে পেয়ে একত্রিত ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন তাদের কৃতকর্মের জন্য মহান স্রষ্টার কাছে এবং স্রষ্টা ও তাদের মাফ করে দুনিয়ার জমিনে সংসার ধর্ম পালন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই থেকে প্রতিটি ঈদগাহ ময়দান আরাফা মাঠের ক্ষুদ্র সংস্করণ যেখানে আদম-হাওয়ার সন্তান সন্ততিরা মিলিত হয়ে প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। এখন প্রশ্ন করোনাজনিত কারণে ইতি পূর্বে দু’দুটো ঈদ জামাত অনুষ্টিত হয়নি দেশের কোথাও।এবারের ঈদের নামাজ ও ঈদগাহ মাঠে হবে না মর্মে পূর্ব থেকেই ঈঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আমার প্রশ্ন মাঠগুলোর পরিবর্তে মসজিদে মসজিদে ঈদের নামায আদায়ে করোনা পরিস্থিতির কোনো সুফল বয়ে আনছে কি?মাঠে নামাজ হয়না নামাজ হয় মসজিদে মসজিদে ঠাসাঠাসি অবস্থায় ঈদের জামাত অনুষ্টিত হয়।আমি বলবো মসজিদে মসজিদে ঈদ জামাত হলে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিতই হয়।সরকার ব্যবসায়ীদের দাবিতে হাটবাজার খুলে দিয়েছে ফলশ্রুতিতে হাটবাজারের,শহরে বিপনী বিতানে প্রচন্ড ভীড়।দুর পাল্লার বাস,ট্রেন চলছেনা ঠিকই কিন্তু মানুষের চলাচল যাতায়াত কিন্তু আছে? চড়ামূল্যে বিকল্প ব্যবস্থায় মানুষ তার গন্তব্যে যাচ্ছেই।খোদ ঢাকা শহরের নিউ মার্কেট,যমুনা পার্ক,বসুন্ধরা, গুলিস্থান,সদর ঘাট সহ সারা ঢাকার অবস্থার দিকে যদি তাকাই তাহলে যে চিত্র ভেসে উঠে তা বীভৎস। সর্বত্র লোকের গাদাগাদি, মাস্ক পড়ছেনা ৬০-৮০% মানুষ,একটা বড় অংশের মানুষের মাস্ক পকেটে থাকে,নাকে মুখে থাকে না। সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু মহোদয়ের সুপ্রীম কোর্ট চত্বরে জানাযার চিত্র তা ছাড়া সারা দেশেই হাজার হাজার মুসল্লী সমাগমে যত্রতত্র জানাযা হচ্ছে। মানুষ এবং যানবাহনের ভিড়ের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ের/উপজেলা পর্যায়ের হাটবাজার গুলোতে ঢোকাই মুশকিল। প্রত্যেকটা হাটবাজারে নারী পুরুষের ঠাসাঠাসি, জেলা উপজেলার প্রতিটি রাস্তায় যানজট।লক ডাউনের কোন চিত্র আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। তারাবীহ নামাজের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিটি মসজিদে ২০ জন নামাজ পড়ার কথা বললে ও নামাজ পড়ে ২০০ জন।আমি যে ঈদগাহ মাঠের সভাপতি সেই মাঠে আকস্মিকভাবে সমবেত জনগণের প্রশ্ন হাটবাজার, মেডিকেলের ইন্টারভিউ,জানাযা সব যদি পূর্ববৎ ঠিক ঠাক চলে তবে শুধু ঈদের নামাজ ঈদগাহ মাঠে পড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কারণ কি? বাংলাদেশের বছরে দু’দিন মাত্র নামায হয় ঈদগাহ ময়দানে বাকী ৩৬৩ দিন মাঠগুলো ফাঁকা থাকে খা খা করে।এই ভাবে চলতে থাকলে ঈদগাহ ময়দান গুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে এবং ভবিষ্যতে মানুষ আর ঈদগাহ মুখী হবে না এতে করে ইসলামী ঐতিহ্য কৃষ্টিতে আসবে চরম আঘাত।
আমি মনে করি স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ অনুসরণ করে খোলা ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়া মসজিদে গাঁদা গাঁদি অবস্থায় নামাজ পড়া থেকে নিঃসন্দেহে উওম।তবে সরকার এই মর্মে সিদ্ধান্ত দিতে পারে যে,যেসব ঈদগাহে সারা দেশ থেকে মুসল্লীর সমাগম ঘটে যেমন শোলাকিয়ার ময়দান ঐসব ঈদগাহে শুধু স্থানীয়রা ছাড়া বাইরের কারো আসা নিষিদ্ধ।তাছাড়া অধিক মানুষের সমাগম যে মাঠে হয় সেসব মাঠে এক বারের পরিবর্তে ২/৩ বার নামাজ পড়া যেতে পারে প্রতি নামাজ শেষে ঘন্টা খানেক বিরতি দিয়ে। ঈদগাহের প্রবেশ পথে পুলিশ/আনসার/ভিডিপি নিয়োজিত রেখে শতভাগ মাস্ক পড়া নিশ্চিত করা সহ বাধ্যতামূলক হাত সেনিটাইজ নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রবেশ পথে প্রতিটি মুসল্লীর শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
আমি কিছুক্ষণ নোয়াগাঁও ইসলামাবাদ ঈদগাহ মাঠে মুসল্লীদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি এ দেশে কখন কে মরে তার বাচাঁ মরার গ্যারান্টি নেই কাজেই জীবনে শেষ বারের মত ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে না পারার দুঃখটা তাদের মনের মধ্যে রয়ে যাবে।ইফতারের পূর্বক্ষণে মাঠ থেকে বাড়ী মুখী হলাম।আমার মনে হল নয়নাভিরাম মাঠটি যেন বিষন্নতার কাল চাঁদরে ঢাকা মাঠটি যেন গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে আর বলছে আমাকে আর পরিত্যক্ত রেখোনা তোমরা এসো। তোমরা এলেই আমি পূর্ণতা পাব। সব দিক চিন্তা করে আমি ধর্ম প্রান মুসল্লীদের পক্ষে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ও মাননীয় ধর্ম মন্ত্রী বরাবরে এই অনুরোধ টুকু করতে চাই ইসলামী কৃষ্ঠি রক্ষার্থে ঈদগাহ ময়দান গুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ পড়ার অনুমতি দানে আপনার সদয় হবেন কি?