শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী ২০২১
প্রথম পাতা » আর্ন্তজাতিক | শিরোনাম | সাবলিড » নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ- সম্পর্ক কেমন হবে?
নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ- সম্পর্ক কেমন হবে?
বিবিসি২৪নিউজ, খান শওকত যুক্তরাষ্ট্র থেকেঃ নতুন মার্কিন প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের বেশ কিছু সুযোগ তৈরি হবে৷ তবে মানবাধিকার আর গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ কীভাবে কাজ করে তা গুরুত্বপূর্ণ৷
শপথ নেয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মানবাধিকার আর গণতন্ত্রকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখছেন৷ ডনাল্ড ট্রাম্পের অনেক নীতিই উল্টে দিচ্ছেন তিনি৷ প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ আর তাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে৷ কারণ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি৷ মিয়ানমারের ব্যাপারেও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে নতুন মার্কিন প্রশাসন৷ রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন কিনা তা আবারও খতিয়ে দেখতে চান তারা৷ আর এটা মিয়ানমারকে চাপে ফেলবে৷ যা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে যাবে৷
জো বাইডেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছেন৷ আর এর সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত৷ সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল(অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘‘জো বাইডেন সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন যেসব দেশে মানবাধিকারের ঘাটতি আছে সেটা তারা দেখবেন৷ আমার মনে হয় এখানে আমাদের ঘাটতি আছে৷ এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও যুক্ত৷”
একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যে আবার আমদানি-রপ্তানির হিসাব বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে৷ গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানির মধ্যে ৬ বিলিয়নই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ের ১ হাজার ৫৩২ কোটি মার্কিন ডলারের যে রেকর্ড হয়, তার মধ্যে ২৩৮ কোটি ডলারই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷ দীর্ঘদিন যাবত দেশটি বাংলাদেশর প্রবাসী আয়ের শীর্ষ ৫ দেশের মধ্যে থাকছে৷
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক৷ এই পণ্যও সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রপ্তানি কিছুটা পড়তির দিকে৷
জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করা যায়৷ যদিও তৈরি পোশাকখাত কোনোদিনই এই সুবিধা পায়নি, তথাপি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা বাতিল করে দেয়৷ বাংলাদেশ সরকার এখন বলছে, জিএসপি সুবিধা পাওয়া পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ কম হওয়ায় এটা কেবল মর্যাদার প্রশ্ন হয়ে আছে৷
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণের ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে বাংলাদেশের তিক্ততার পর আসে মার্কিন নির্বাচন৷ সেখানে মুসলিমবিরোধী নানা মন্তব্য করলেও ট্রাম্প জিতে যাওয়ার পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে উষ্ণ অভিনন্দন জানায় বাংলাদেশ সরকার৷
ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তিতে বাংলাদেশ সরাসরি ছিল না৷ তবে এটা ঘিরে বাংলাদেশের উদ্বেগ ছিল৷ কারণ, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে যেতো৷ তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান এই রপ্তানি পণ্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তো৷ নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে ট্রাম্প এই চুক্তি বাতিল করলে বাংলাদেশ সরকার থেকে অভিনন্দনও জানানো হয়৷
অদূরে চীন, পাশেই ভারত৷ সীমান্ত রয়েছে চীনের দীর্ঘদিনের মিত্র মিয়ানমারের সঙ্গেও৷ ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পায় বড় শক্তিগুলোর কাছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ স্বল্প উন্নত দেশগুলোর পক্ষে ভূমিকা রেখেও আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভূক্তভোগী দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের কথা রয়েছে৷ ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় টান পড়বে এই অর্থ জোগানে৷ এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কার্বন নিঃসরণ না কমালে এর ফল ভোগ করতে হবে বাংলাদেশকেও৷
জাতিসংঘ পরিচালিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বড় একটা অংশ বাংলাদেশের৷ এটা বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়েরও একটা উৎসে পরিণত হয়েছে৷ অন্যদিকে জাতিসংঘের বাজেটের বড় একটা অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যা কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন ট্রাম্প৷ সেক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা মিশনসহ অনেক কাজ পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে বলে জানায় সংস্থাটির এক মুখপাত্র৷ এটা উদ্বেগে ফেলেছে বাংলাদেশকেও৷
মিশিগানে সন্ত্রাস বিরোধী ব়্যালি, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি
যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ অভিবাসী কমাতে ট্রাম্পের নানা পদক্ষেপ সমস্যায় ফেলবে সেখানে থাকা অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে৷
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে বড় একটা জায়গা জুড়ে থাকে দেশটির গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি৷ বাংলাদেশে নিয়োগ পাওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রায়ই এটা নিয়ে কথা বলতে বা সক্রিয় হতে দেখা যায়৷
তার মতে সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানবাধিকার রক্ষায় যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশকেও সেদিকে নজর দেয়া উচিত৷ বিশেষ করে বাক স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, বিরোধী দলকে জায়গা দেয়া, মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে সম্মান দেখানো জরুরি৷
রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে বাংলাদেশের সামনে বড় একটি সুযোগ আসতে পারে৷ কারণ নতুন মার্কিন প্রশাসন মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন কিনা তা নতুন করে দেখবে৷ আগে তারা এটা দেখতে চায়নি৷ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘‘এটাকে বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারবে৷ আর সার্বিকভাবে মানবাধিকারকে নতুন প্রশাসন গুরুত্ব দিচ্ছে৷ এটাও মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াবে৷”
শহীদুল হক মনে করেন, মিয়ানমারের ব্যাপারে নতুন মার্কিন প্রশাসন ঠিক কতদূর যাবে তা এখনো নিশ্চিত না হলেও এই জায়গায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা দরকার৷ যদি অ্যামেরিকার ট্রেজারি মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করে সেটা হবে তাদের জন্য ভয়াবহ৷ যা বাংলাদেশের সঙ্গে বসে তাদের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাধ্য করতে পারে৷
‘‘মানবাধিকারের ঘাটতি আমাদের আছে’’: শহীদুল হক
অভিবাসন নীতির কারণে এবার অনেক বাংলাদেশি যারা সেখানে রয়েছেন তাদের সুবিধা হবে৷ শিক্ষা ভিসা বাড়বে৷ আর বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যেও সুবিধা হবে৷ আগামী এক দেড়-বছর চীনের সাথে অ্যামেরিকার ব্যবসা বাণিজ্যে দূরত্ব থাকছে৷ তা থাকলে বাংলাদেশ ঠিকমত এগোতে পারলে এর সুবিধা পাবে৷
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির যে দীর্ঘদিনের অবস্থান ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখা, তার পরিবর্তন এরইমধ্যে হয়েছে৷ এটা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে৷ বাংলাদেশের বাজার এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বাড়বে৷ তবে সেটা কতটা বাড়বে তা নির্ভর করবে চীন নীতির ওপর৷” বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু তৈরি পোশাক নয়, আইটিসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এখন সুবিধা পাওয়া কথা৷ জিএসপি না পেলে কার্ডটি ঠিকমত খেলতে পারলে সুবিধা পাওয়া যাবে৷
তৌহিদ হোসেন বলেন, সরকারের পরিবর্তন হলেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন হয় না৷ কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্প এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা পাল্টাতে হচ্ছে জো বাইডেনকে৷ ট্রাম্পের সময় আসলে বাংলাদেশ তেমন কোনো সুবিধা পায়নি৷ জিএসপি সুবিধা বারাক ওবামার সময় থেকেই নাই৷ এখন যে হবে তার সম্ভাবনাওদেখা যাচ্ছে না৷ কারণ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সেই পর্যায়ে এখন নাই৷
‘‘বাজার এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে’’: তৌহ…
তার মতে,‘‘জলবায়ু ফোরামে ফিরে যাওয়া এবং মানবাধিকারের বিষয়টি প্রধান্য দেয়া বাংলাদেশের জন্য সুবিধার হতে পারে৷”
তবে সব কিছু নির্ভর করছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার ওপরে৷ বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারের মিয়ানমারকে আরো চাপে ফেলতে প্রয়োজনে এখন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক লবি নিয়ে কাজ করতে হবে৷ আর বাংলাদেশকেও মানবাধিকার আর গণতন্ত্র নিয়ে স্বচ্ছ থাকতে হবে বলে মনে করেন শহীদুল হক৷
আর সম্প্রতি বাংলাদেশে আল কায়েদা নিয়ে মার্কিন বক্তব্যকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না তৌহিদ হোসেন৷ তিনি মনে করেন তারা অনেক দেশ নিয়েই এটা বলে৷ বাংলাদেশ তার অবস্থান প্রতিবাদ জানিয়ে সঠিকভাবেই উপস্থাপন করেছে৷