বুধবার, ৮ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » বিশেষ প্রতিবেদন | শিরোনাম » করোনাভাইরাস: পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টে কতটা প্রস্তুত স্বাস্থ্য খাত?
করোনাভাইরাস: পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টে কতটা প্রস্তুত স্বাস্থ্য খাত?
বিবিসি২৪নিউজ,বিশেষ প্রতিবেদক,আব্দু শহিদ: বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয় ৮ই মার্চ। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার একমাস হচ্ছে বুধবার। মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৬৪জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের।কিন্ত একমাসে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৩৩ জন। মঙ্গলবারই ৪১ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত করার তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর পরীক্ষার হার যত বাড়ছে, রোগীর সংখ্যাও অনেকটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
একমাসের পরিস্থিতি কীভাবে বিশ্লেষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী বলছেন, “পশ্চিমা দেশ নয়, আমরা ভারত বা ব্রাজিলের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তখন কিন্তু দেখা গেছে এরকম একটা পর্যায়ে এসে তাদের রোগীর সংখ্যা বহু হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আমাদেরও হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সেরকম একটা চিত্র দেখতে হবে।”
“কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সেজন্য প্রস্তুত কিনা? আমরা হয়তো রোগী শনাক্ত করতে সক্ষম হবো, কিন্তু পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য আমাদের স্বাস্থ্য খাত কতটা প্রস্তুত হয়েছে? আমাদের কি যথেষ্ট আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, চিকিৎসক প্রস্তুত রয়েছে কিনা। রোগী সামলানোর ব্যাপারটি হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
তিনি বলছেন, “পরীক্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেটাই এখনো প্রকৃত চিত্র কিনা বলা যাবে না। কারণ আমরা পরীক্ষা কেন্দ্র সবেমাত্র বাড়িয়েছি। এই যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে, তাতে পরীক্ষার সংখ্যা আরো বাড়লে হয়তো আসল চিত্রটা বোঝা যাবে।”
“রোগটি প্রতিরোধ করতে হলে লকডাউনের ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা যত ভালোভাবে আমরা সেটা করতে পারবো, ততো স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ কম পড়বে। সেজন্য ত্রাণ, আইনশৃঙ্খলা, মানুষের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীয় সমন্বয় ব্যবস্থা থাকা দরকার।”
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ বলছেন, “যেভাবে সবকিছু হওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি। কোয়ারেন্টিনের কথাই যদি বলেন, বিদেশ থেকে যারা এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টিন ঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি অনেকের নাম ঠিকানাও ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। প্রথমেই আমরা সেই সুযোগটা মিস করেছি।”
“টেস্ট করার সক্ষমতা থাকার পরও এতোদিন পরে টেস্ট বাড়ানো হয়েছে। প্রথম থেকে যদি সেটা করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে ধরা যেতো, ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সেটাও ঠিক সময়ে করা হয়নি।”
“যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিংও ঠিকভাবে হয়নি। তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কি করেছেন, সব বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল। তাহলে ঝুঁকি অনেক কমতো। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি- সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে সেটা করা উচিত ছিল।”
তিনি বলছেন, যারা শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের ঠিকভাবে চিকিৎসা করা, সংক্রমিতদের সীমাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি জরুরি। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ সুরক্ষার ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে হাসপাতালগুলো বা চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে শুরু করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অনেক হুমকি তৈরি করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, প্রথম থেকেই রোগটি ব্যবস্থাপনায় একটা সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। শুধু একটা জায়গায় টেস্ট সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, অনেক দেরি করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন রোগীর সংখ্যা কমিয়ে রাখার একটা চেষ্টা করা হয়েছে।
“এখনো এক্ষেত্রে একটা সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এখন যে রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তারা কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে, তা নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে।” রোগীর সংখ্যা যতো বাড়বে, ততো এই পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে তার আশঙ্কা।
সেদিন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন নারী ও দুইজন পুরুষ।
তাদের মধ্যে দুইজন ইতালি থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। অপর একজন তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
তিনি জানিয়েছিলেন, আক্রান্তদের মধ্যে দুইজন ব্যক্তি দেশের বাইরে থেকে এসেছেন। দেশে আসার পর তাদের লক্ষ্মণ ও উপসর্গ দেখা দিলে তারা আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন। পরে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হলে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে।
ইতালি থেকে আসা ওই দুইজন দুইটি আলাদা পরিবারের সদস্য। তাদের নমুনা সংগ্রহের সময় পরিবারের আরও চারজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেই চারজনের মধ্যে একজন নারীর করোনাভাইরাস ধরা পড়ে।
এই ঘোষণা আসার পর মাস্ক, স্যানিটাইজারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। অতিরিক্ত দাম রাখার কারণে বেশ কয়েকটি ফার্মেসি সিলগালা করে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর পরবর্তী কয়েকদিন ধরে আর নতুন কোন রোগী পাওয়ার খবর জানায়নি আইইডিসিআর।
১১ই এপ্রিল সংস্থাটি জানায়, যে তিনজন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুইজন সুস্থ হওয়ার পথে। আরেকটি পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলে তারা সুস্থ জানিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে।
কিন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ হলে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকটি হটলাইন নম্বর চালু করা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। তবে অনেকেই অভিযোগ করেন, বারবার চেষ্টা করেও তারা এসব হটলাইনে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি। ১৩ই মার্চ আইইডিসিআর জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। নতুন রোগী পাওয়া যায়নি।