৩০ বছর পরেও কাশ্মীরে ফিরতে চায় পন্ডিতরা
বিবিসি২৪নিউজ,দিল্লি প্রতিনিধি:ভারত-শাসিত কাশ্মীর থেকে হিন্দু পন্ডিতদের নির্বাসনের তিরিশ বছর পূর্তিতে ওই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের ভিডিও পোস্ট করে আওয়াজ তুলছেন ‘হাম আয়েঙ্গে আপনা ওয়াতন’ - যার অর্থ ‘নিজেদের মুলুকে আমরা ঠিক ফিরব’।১৯৯০ সালের ১৯শে জানুয়ারির রাতে হাজার হাজার কাশ্মীরি পন্ডিত প্রায় এক বস্ত্রে ভ্যালি বা কাশ্মীর উপত্যকায় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ধারণা করা হয় এর পর কয়েক লাখ পন্ডিত সেখান থেকে ভিটেছাড়া হয়ে চলে এসেছেন।
গত তিন দশক ধরে ভারতেরই নানা প্রান্তে তারা একরকম শরণার্থীর জীবন যাপন করছেন।
গত আগস্টে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর সরকার দাবি করেছিল এরপর সেখানে পন্ডিতদের ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হবে, তবে বাস্তবতা কিন্তু অন্য রকমই বলছে।
“হাম আয়েঙ্গে আপনা ওয়াতন হাজীসাহাব
অওর এহি পে দিল লাগায়েঙ্গে।
এহি মরেঙ্গে
অওর এহিকে পানি মে হামারি রাখ বহায় যায়েগি।”
ভারতের নামী মঞ্চ অভিনেতা চন্দন সাধু, যিনি নিজে একজন কাশ্মীরি পন্ডিত, এই পংক্তিটি আবৃত্তি করে নিজের টুইটারে পোস্ট করেছিলেন দুদিন আগে
‘শিকারা’ নামে একটি আসন্ন মুভির সংলাপ এটি, যাতে বলা হয়েছে ‘হাজীসাহাব, আমি ঠিক একদিন ফিরব - ওখানেই মন বসাব, ওখানেই মরব, আর কাশ্মীরের নদীতেই আমার ছাই ভেসে যাবে।’
এরপরই রাতারাতি এই লাইনগুলো যেন ভাইরাল হয়ে উঠেছে।
পন্ডিত সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার লোকজন ভ্যালি থেকে তাদের নির্বাসনের ৩০ বছর পূর্তিতে আবার ঘরে ফেরার শপথ নিচ্ছেন এই উচ্চারণেই।
এদের মধ্যে আছেন এফএম রেডিও-র জনপ্রিয় মুখ খুশবু মাট্টু কিংবা সাংবাদিক আদিত্য রাজ কাউল, লেখক রাহুল পন্ডিতাও। খুশবু মাট্টু পোস্ট করেছেন বিবিসিকে তিন বছর আগে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারও, যেখানে তিনি বলেছিলেন কাশ্মীরে একদিন ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তার সমাজের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথাও।
কিন্তু ঠিক কী ঘটেছিল সেই ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারির রাতে, যাতে এক কাপড়ে উপত্যকা ছাড়তে হয়েছিল পন্ডিতদের?
এখন জয়পুরে পন্ডিতদের ক্যাম্পে থাকেন নমিতা কাউল, তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “শীতের সেই রাতে আমরা ঘরে বসে টিভিতে সিনেমা দেখছিলাম।”
“হঠাৎ চারদিক থেকে ‘আল্লা হু আকবর’ ধ্বনি উঠতে লাগল, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ আর ‘ভারতীয় কুকুররা ফিরে যাও’ স্লোগানে আমরা কেঁপে উঠলাম।”
“মসজিদ থেকে হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে দলে দলে মানুষ আমাদের গলি-মহল্লা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল।”
“বলা হল মেয়েরা থাকবে, কিন্তু পুরুষদের চলে যেতে হবে। দেওয়া হয়েছিল হত্যার হুমকিও।”
“সেদিনের কথা ভাবলে আজও চোখ জলে ভিজে আসে, যে আমাদের জীবনে অমনটাও ঘটেছিল!”
জম্মু ও কাশ্মীরের তদানীন্তন গভর্নর জগমোহনের উদ্যোগে সে রাতেই কাশ্মীর থেকে পন্ডিতদের সরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়ে যায়।
এরপর বিগত তিন দশক ধরে তারা নিজ দেশেই পরবাসীর জীবন যাপন করছেন ।অবশ্য এর মাঝে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অধুনালুপ্ত রাজ্য বিধানসভায় অনেকবার আলোচনাও হয়েছে।
পিডিপির সিনিয়র নেতা নাঈম আখতারও মনে করেন, “পন্ডিতরা কাশ্মীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ - তারা অন্য কারও চেয়ে এতটুকুও কম কাশ্মীরি নন।”
“সবচেয়ে বড় কথা, তাদের জন্য আজ কাশ্মীরে ফেরা যত না-দরকার, তাদেরকে ফিরে পাওয়াটা কাশ্মীরেরও অনেক বেশি দরকার।”
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ওমর আবদুল্লাও একাধিকবার বলেছেন, ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে কাশ্মীরের উচিত হবে পন্ডিতদের উপত্যকায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা।
কিন্তু সেখানকার রাজনীতিবিদদের যতই সহানুভূতি থাক, কাশ্মীরের নিরাপত্তা পরিবেশই এমন ছিল যে হিন্দু পন্ডিতরা সেখানে ফিরে গিয়ে কখনও আবার বসত করার ব্যাপারে নিরাপদ বোধ করেননি। মাসছয়েক আগে কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি বাতিল করার সময় পার্লামেন্টে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও দাবি করেছিলেন, “পন্ডিতরা এবং সুফিরাও কাশ্মীরিয়তের অংশ!”
“তারা এতদিনে নিজের ঘরে ফিরতে পারবেন”, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণাও করেছিলেন তিনি।
তবে গত ছ’মাসে ছজন পন্ডিতও কাশ্মীরে ফিরে গিয়ে বসত করতে পেরেছেন এমন কোনও রেকর্ড নেই, আর অদূর ভবিষ্যতে সে লক্ষণ দেখাও যাচ্ছে না।
কিন্তু ৩০ বছর পরেও কাশ্মীরি পন্ডিতদের ঘরে ফেরার সঙ্কল্পে কিন্তু আজও চিড় ধরেনি। এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকেন ভারতের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আভা হাঞ্জুরা।
তবু মনেপ্রাণে এখনও কাশ্মীরি পন্ডিত তিনি।
আর তাই প্রতিটি কনসার্টে অক্লান্তভাবে গেয়ে চলেন, “রোশওয়ালো ইয়ারা দিলবরো, চলো চিনারো কে ঘরোঁ” - ‘চলো বন্ধু, ফিরে যাই চিনার বনের গৃহে!