গণপিটুনিতে হত্যার বিচার হয় না কেন?
বিবিসি২৪নিউজ,বিশেষ প্রতিনিধি:গত তিন বছরে গণপিটুনির শিকার হয়ে ১৫৪ জন নিহত হয়েছেন৷ কিন্তু এ নিয়ে দায়ের করা কোনো মামলারই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই৷ নতুন করে আবার গণপিটুনিতে হত্যার প্রবণতা বাড়ছে৷সোমবার ভোররাতে যশোরের অভয়নগরে ‘গরু চোর’ সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ পুলিশ বলছে, তারা পাশের সদর উপজেলার গাদাইগাছি গ্রামের একটি বাড়ি থেকে তিনটি গরু চুরি করে পালানোর সময় জনতা টের পেয়ে তাদের ধরার জন্য মসজিদের মাইকে সহায়তা চায়৷
পালিয়ে যাওয়ার সময় পাশের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগে জনতার হাতে ধরা পড়ে৷ এরপর ওই এলকার স্কুল মাঠে তাদেরকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়৷
এদিকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ‘গরু চুরির’ অপবাদ দিয়ে রফিকুল ইসলাম নামে এক কিশোরকে হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে শতশত মানুষের সামনে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে শনিবার (১১ জানুয়ারি)৷ পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এই ঘটনা বলে অভিযোগ রয়েছে৷
রোববার (১২ জানুয়ারি) বরগুনার পাথরঘাটা এলাকায় রফিকুল ইসলাম নামে এক যুবক গণপিটুনির শিকার হয়েছেন৷ তবে স্থানীয় এমপির লোকজন এই ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ এমপি নিজেও মারধোর করেন বলে ভুক্তভোগীর পরিবার দাবি করেছে৷ ওই যুবকের পৈত্রিক সম্পত্তিকে স্লুইস গেট নির্মাণে বাধা দেয়ায় তাকে পিটুনি দেয়া হয়৷ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ এই তিনটি ঘটনার কোনোটিতেই পুলিশ কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি৷
গত বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি ভয়াবহ আকার ধারণ করে৷ ২০ জুলাই ঢাকার উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হন তসলিমা বেগম রেনু৷ ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়৷ এই ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠলে পুলিশ সক্রিয় হয়৷ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়৷
কিন্তু এখনো অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি৷ মামলাটি তদন্ত করছে গোয়েন্দা বিভাগ৷ গোয়েন্দা বিভাগের ওই জোনের উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘‘ফুটেজ ও ছবি দেখে আমরা মূল অভিযুক্তসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছি৷ কিন্তু তদন্ত শেষ হয়নি৷ অনেক লোকের উপস্থিতিতে ঘটনা তাই এর তদন্ত সময়সাপেক্ষ৷”
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে ২০১৮ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন৷ সবশেষ ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৬৫ জন হয়েছে৷ জুলাই পর্যন্ত প্রথম সাত মাসেই নিহত হয়েছেন ৫৩ জন৷ গত বছর গণপিটুনিতে হত্যার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে৷ ২৫ জন মারা গেছেন সেখানে৷ ঢাকায় নিহত হয়েছেন ২২ জন৷
বাংলাদেশ ও ভারতে গণপিটুনির ধরন ও প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব নন্দী৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ১০টি গণপিটুনির কোনো বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি৷ সাভারে ছয় ছাত্রকে হত্যা, শাবিপ্রবির ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা, চট্টগ্রামে চারটি বড় ধরনের গণপিটুনির ঘটনায় কোনো বিচার হয়নি৷”
এরমধ্যে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই সাভারের আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ৬ ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যার পর সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল৷ তারা রাতে ঘুরতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন৷ ওই ঘটনায় এখনো বিচার পায়নি নিহতদের পরিবার৷
রাজীব নন্দী বলেন,‘‘আইনের শাসনের কঠোর প্রয়োগ এবং সর্বস্তরে জবাবদিহিতা চালু ছাড়া গণপিটুনি বন্ধ হবে না৷ আর রাজনৈতিক সহিংসতা দূর না হলেও গণপিটুনি বন্ধ হবে না৷ তবে আইনের শাসনের অনুপস্থিতিই গণপিটুনির প্রধান কারণ নয়৷
যেহেতু কিছু কিছু গণপিটুনির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণপিটুনির পর জনতা নিজ উদ্যোগে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে ভিকটিমকে৷ এটা প্রমাণ করে এখানো আইনের প্রতি মানুষ পুরোপুরি আস্থা হারায়নি৷”
তবে তিনি মনে করেন, ‘‘যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হবে, যখন উন্মত্ত জনতার আদালত সর্বস্তরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে৷ যা এক কথায় অরাজক অবস্থা৷”
মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে মশিউর রহমান বলেন, ‘‘এটা অনেক মানুষের ঘটনা৷ প্রধান সমস্যা হলো সাক্ষী পাওয়া কঠিন৷ গণপিটুনির সময় অনেক লোক থাকলেও যে কারণে তারা উদ্ধার করতে যান না, একই কারণে তারা সাক্ষ্যও দেন না৷ আর যারা কথা বলেন তারাও তো সব সময় চেনেন না যে কারা ঘটনা ঘটিয়েছে৷