বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » জাতীয় | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশে আজ ভোরে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে
বাংলাদেশে আজ ভোরে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে
বিবিসি২৪নিউজ, নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা: রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর আজ বুধবার ভোরে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।
আজ ভোর ৪টা ৪০ মিনিট থেকে এই ট্রেন চলাচল শুরু হয় বলে জানিয়েছেন কমলাপুরের স্টেশনমাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আজ ভোরে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। দেশের অন্যান্য স্টেশন থেকেও ট্রেন ছেড়েছে। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো গোলযোগের খবর নেই।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফরা সোমবার মধ্যরাত থেকে ধর্মঘট শুরু করেছেন। মাইলেজ ভাতা ও সুবিধার দাবি আদায়ের জন্য ডাকা এই ধর্মঘটের কারণে সারাদেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বিআরটিসি বাস দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। রেলের টিকিটেই তারা বাসে যেতে পারছেন।
কিন্তু তাতে সমস্যার তেমন সমাধান হচ্ছে না। কারণ, রেলের বিপুল সংখ্যক যাত্রীকে বাস দিয়ে সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার কমলাপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেন যাত্রীরা স্টেশনে গিয়ে ট্রেন না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। অনেকেই অনলাইনে আগাম টিকিট কিনে পড়েছেন বিপাকে। রাজশাহীতে বিক্ষুব্ধ যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছেন স্টেশন মাস্টার। ময়মনসিংহে যাত্রীদের তোপের মুখে পড়েন স্টেশন সুপার। পালিয়ে যান চালক। আরো অনেক রেল স্টেশনে একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। রেল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যানা গেছে যারা ধর্মঘট ডেকেছে সেই রানিং স্টাফরা সংখ্যায় কম হলেও তারা ট্রেন চালানোর সঙ্গে জড়িত। তাদের ছাড়া ট্রেন চালানো সম্ভব নয়।
ধর্মঘট যারা ডেকেছেন, তাদের কেউ কেউ রাতে এবং সকালে রেল স্টেশনে থাকলেও পরে তাদের আর দেখা যায়নি। তারা যাত্রীদের রোষ এড়াতে নিরাপদে চলে গেছেন বলে জানা যায়।
তার আগে মঙ্গলবার সকালে কমলাপুরে রেলওয়ে রানিং স্টাফ কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা রেলের রানিং স্টাফরা ১৬০ বছর ধরে যে সুবিধা পেতাম, সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকার ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর তা বাতিল করে দেয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে আমরা ধর্মঘট করে ট্রেন বন্ধ করে দিলে ওই আদেশ স্থগিত করা হয়, কিন্তু বাতিল করা হয়নি। আমরা কোনো সুবিধাও পাচ্ছি না।২০২৩ সালে নিয়োগের নীতিমালায় রানিং স্টাফদের মাইলেজ সুবিধাই রাখা হয়নি। আমরা সরকারের প্রজ্ঞাপন বাতিল এবং আগে যে সুবিধা ছিল, তা ফেরত চাই।”
‘‘ আমাদের চাকরির ধরনই হলো পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন আমাদের ট্রেনে থাকতে হয়। ফলে ওভারটাইম এবং পেনশনে আমাদের মাইলেজ সুবিধা দেয়া হতো। কত মাইল বাড়তি কাজ করা হলো, তার ভিত্তিতে এই সুবিধা,” বলেন তিনি।
এদিকে সকালে রেলের পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে যান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি তখন বলেন, ‘‘যাত্রীদের জিম্মি করে বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মসূচি দুঃখজনক। এতে সাধারণ মানুষই বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে।”
তিনি বলেন, ‘‘স্টাফদের দাবির বিষয়ে আমাদের আলোচনার দরজা সব সময় খোলা আছে। প্রয়োজনে আমরা তাদের সঙ্গে আবারও আলোচনা করবো এবং অর্থ বিভাগেও তাদের এই দাবি নিয়ে আলোচনা করবো।”
উপদেষ্টা বলেন, ‘‘যাত্রীদের ভোগান্তি যাতে কম হয়, সে জন্য এরই মধ্যে গণমাধ্যমে সবাইকে জানিয়েছি। এরপরও কোনো যাত্রী যদি স্টেশনে আসেন, তাদের সুবিধা বিবেচনা করে আমরা বিআরটিসি বাসের ব্যবস্থা করেছি, যাতে রেলের যে রুটগুলো আছে, সেখানে যাত্রীরা যেতে পারেন।”
রেলপথ উপদেষ্টা বলেন, ‘‘স্টাফদের যে মাইলেজ অ্যালাউন্সের দাবি, তা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। তাদের এই দাবির অনেকাংশই আমরা এরই মধ্যে পূরণ করেছি। বাকি দাবিগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করতে প্রস্তত। রেল তো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না, এখানে আলোচনার সুযোগ আছে।”
এ সময় সেখানে উপস্থিত বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘কমলাপুর ও এয়ারপোর্ট স্টেশনে যাত্রীদের জন্য ১০টি করে মোট ২০টি বাস প্রস্তত আছে। প্রয়োজন হলে বাস আরো বাড়ানো হবে।”
রানিং স্টাফ কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা যাত্রীদের এই ভোগান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা প্রস্তুত আছি সরকার আমাদের দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিলেই আমরা ট্রেন চালু করে দেবো। এক মিনিটও দেরি করবো না।”
এদিকে দুপুরের পর কমলাপুর রেল স্টেশনে রানিং স্টাফদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কর্র্তৃপক্ষ। তবে কোনো সমাধান ছাড়াই ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে গেছেন রানিং স্টাফ নেতারা।
বৈঠকে ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। বিএনপির চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও ছিলেন সেখানে।
বেঠক শেষে রানিং স্টাফদের প্রতিনিধি সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘক্ষণ রেলসচিব, মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তবে কোনো সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারিনি বলে ওই বৈঠক চলাকালীনই আমি চলে এসেছি। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যারা আছেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করবো। তবে আমরা আমাদের কর্মবিরতিতে অনড় আছি।”
রানিং স্টাফদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয়ে আমি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। আমরা বলেছি, আমাদের আলোচনার দ্বার খুলে রেখেছি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য জোটের মহাসচিব এ আর মঞ্জু বলেন, ‘‘সংখ্যার দিক দিয়ে রানিং স্টাফরা কম হলেও তারা ছাড়া ট্রেন চালানো সম্ভব নয়। তারাই ট্রেন চালনা ও চলন্ত ট্রেনের সব ধরনের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। আর তারা নির্ধারিত বেতনের বাইরে যে সুবিধা পান, সেটাকে মাইলেজ ভাতা বলে। আট ঘণ্টা ডিউটির পর তাদের ওভার টাইম হয় মাইল হিসাব করে। ২০২১ সালে তাদের এই সুবিধা বাতিল করা হয়।”
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ট্রেনের গার্ড, লোকোমাস্টার, সহকারি লোকোমাস্টার, সাব লোকো মাস্টার এবং টিটিইরা রেলের রানিং স্টাফ। সারাদেশে রেলওয়েতে এক হাজার সাতশ’র বেশি রানিং স্টাফ কাজ করেন।
দৈনিক কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে ১৫-১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সেজন্য তাদের আগে বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেয়া হতো, যাকে বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ।
মাইলেজ বিবেচনায় প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। আট ঘণ্টায় এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা তিন মাসের সমপরিমাণ। তাদের বেতনও সেভাবেই দেয়া হতো। এর বাইরে মূল বেতনের হিসাবে অবসরকালীন ভাতা যা হয়, তার সঙ্গে অতিরিক্ত আরো ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে রানিং স্টাফদের পেনশন দেয়া হয়৷ ২০২২ সালের পর নিয়োগপত্রে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা পাবেন না এবং মাসিক রানিং অ্যালাউন্সের পরিমাণ মূল বেতনের চেয়ে বেশি হবে না।
এর আর মঞ্জু বলেন, ‘‘রানিং স্টাফদের দাবিকে আমরা যৌক্তিক মনে করি। কারণ, তারা যে শর্তে নিয়োগ পেয়েছেন সেই শর্ত ও সুবিধা বাতিল করা যায় না। তবে আমরা চেয়েছিলাম ধর্মঘট না করে যাতে সমস্যার সামাধান করা যায়। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। উপদেষ্টার সঙ্গেও বসবো। আশা করি সমস্যার সমাধান হবে।”
রেলের দুর্নীতি ও আন্দোলনের বাস্তবতা
বাংলাদেশ রেলওয়ে দুর্নীতি ও লোকসানের কারখানাহিসেবে পরিচিত। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গত ১৫ বছরে ৩০টি লোকোমোটিভ ক্রয়, ডেমু ট্রেন ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণসহ রেলখাতে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে অভিযান চালিয়ে ২১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা পায় বলে দাবি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর।
অভিযানকালে টিম ৩০টি লোকোমোটিভ ক্রয়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের আবাসিক উন্নয়ন, রেলপথ নির্মাণ, ডেমু ট্রেন ক্রয় ও ব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত পরিচালনা ব্যয়, পূর্বাঞ্চলে রেলপথ ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত মূল্যে যন্ত্রপাতি ক্রয় প্রভৃতি বিষয়ক ৭টি অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র যাচাই করে।
গত এক যুগের বেশি সময়ে রেলের লোকসান ছাড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল এক হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা আর ব্যয় তিন হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। একই অর্থবছরে রেলের মোট লোকসান হয় এক হাজার ৫২৪ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে রেলের উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ৬০০ কোটি টাকারও কম। আর ২০২৪ সালে সেই বরাদ্দ ঠেকেছে দুই হাজার ৫৩৩ কোটি টাকায়। নতুন রেলপথ নির্মাণ, প্রতিস্থাপন, সংস্কার, আধুনিক ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় ছিল বরাদ্দ বাড়ার অন্যতম কারণ। সঙ্গে যাত্রী নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টিও ছিল। পাশাপাশি রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার টার্গেটও ছিল সরকারের। গত ১৫ বছরে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এতকিছুর পরও গতি বাড়েনি ট্রেনের।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট)-এর অধ্যাপক এবং পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘‘লোকসান আর দুর্নীতি তো সরকারের জানা। এখানে অতিরিক্ত পরিচলন ব্যয় একটি বিষয়। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় আছে। আর বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি তো আছেই। আমাদের পাশের দেশ ভারতে রেল লাভজনক। কিন্তু ওইসব কারণে আমাদের দেশে লোকসান করছে।”
“তবে রানিং স্টাফরা যে দাবিতে আন্দোলন করছে, তা যৌক্তিক বলে মনে করি। কারণ, তাদের সে মাইলেজ সুবিধার শর্তে চাকরি দেয়া হয়েছে, সেই শর্ত তো বাতিল করা যায় না,” বলেন তিনি।
তার কথা, ‘‘সরকার যদি আগেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতো, তাহলে যাত্রীদের এই দুর্ভোগ হতো না।”