শুক্রবার, ২ আগস্ট ২০২৪
প্রথম পাতা » আর্ন্তজাতিক | এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য | শিরোনাম | সাবলিড » হানিয়া হত্যা: হামাসের নেতৃত্বশূন্যতা যে ভাবে কাটবে
হানিয়া হত্যা: হামাসের নেতৃত্বশূন্যতা যে ভাবে কাটবে
বিবিসি২৪নিউজ,আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানে ‘গুপ্ত হামলা’য় ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের গাজায় স্বাধীনতাকমী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের নেতৃত্বের একটি পর্বের অবসান হল। প্রশ্ন উঠেছে, সংগঠনটিতে যে নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হল, তা কাটবে কীভাবে, কে ধরবেন হাল?
হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হানিয়াকে সংগঠনের রাজনৈতিক কৌশলপ্রণেতা হিসেবে মান্য করত সর্বস্তরের সদস্যরা। আবর দেশগুলোর সঙ্গে তার সখ্য ছিল। কঠিন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার সময়োপযোগী পদক্ষেপ তার মাথা থেকেই আসত। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসলায়েলি আগ্রাসন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বৈরুতভিত্তিতক মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক সামি নাদের আলজাজিরাকে বলেছেন, এই মুহূর্তে হানিয়ার একজন যোগ্য উত্তরসূরি বা বিকল্প কাউকে খুঁজে বের করা হামাসের জন্য খুবই কঠিন। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের সঙ্গে হানিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল এবং চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনা তার ইশারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল।
হানিয়ার নেতৃত্বের আমলে হামাস ‘মধ্যপন্থি’ হিসেবে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় বেশ সফল হয় এবং আবর দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তোলে, বলছেন সামি নাদের।
শুধু তাই নয়, সামি নাদেরের ভাষ্য- হানিয়ার ডেপুটি সালেহ আল-আরৌরি গত জানুয়ারিতে ইসলায়েলি হামলায় নিহত হওয়ায় এখন দলের উত্তরসূরি নির্বাচন আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
আলজাজিরা বলছে, জীবিত থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হানিয়ার পদে হয়ত দেখা যেত আল-আরৌরিকে। অবশ্য তার মৃত্যুর পর আট মাস কেটে গেলেও একজন ডেপুটিই বসাতে পারেনি পারেনি হামাস।
ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর লিখেছে, হানিয়ার মৃত্যুতে হামাসের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব ঝুঁকিতে পড়েছে। সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারবে নাকি আবার গেরিয়া গোষ্ঠীতে পরিণত হবে, সেটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধের এই কঠিন সময়ে হামাসকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে তাদের এমন একজন রাজনৈতিক নেতা প্রয়োজন, যিনি কূটনৈতিকভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ।
এ বিষয়ে ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলেছিল। তার কাছে জানতে চেয়েছিল হানিয়ার উত্তরসূরি নির্বাচনে তারা কী চিন্তা করছেন, কাউকে বেছে নেওয়ার আলোচনা চলছে কি না।
সংগঠনের শর্ত অনুযায়ী পরিচয় গোপন রেখে ওই কর্মকর্তা বলেন, এখনও এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেননি তারা। কাতারের দোহায় হানিয়ার দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তার উত্তরসূরি বাছাইয়ের বিষয়ে কথা হবে।
হামাসের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্তর হল সুরা কাউন্সিল। ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর লিখেছে, তারা জানতে পেরেছে দ্রুতই সুরা কাউন্সিলের বৈঠক হবে এবং সেখানে আলোচনার ভিত্তিতে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান বেছে নেওয়া হবে।
হামাসের সুরা কাউন্সিলের সদস্যদের পরিচয় কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়। গাজা উপত্যকা, পশ্চিমতীর ও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের মধ্য থেকে এই কাউন্সিলের সদস্য সংগ্রহ করা হয়। তারাই মূলত হামাসের বিভিন্ন শাখার প্রধানদের বাছাই করে থাকেন।
ফিলিস্তিনে সক্রিয় সংগঠনগুলো সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর পলিসি, রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি স্টাডিজের প্রধান হানি আল-মাসরি বলছেন, হামাসের সাবেক নেতা খালেদা মেশাল এবং হানিয়ার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত খলিল আল-হায়ার মধ্যে যে কোনো একজন হয়ত হামাসের রাজনৈতিক প্রধান হতে যাচ্ছেন।
খলিল আল-হায়া হামাসের মধ্যে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং সংগঠনের খুঁটিনাটি বিষয়ে তার দখল রয়েছে। তার কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাও চোখে পড়ার মত।
মেশালের সময়ে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলেও তা মেরামতে ভূমিকা রাখেন আল-হায়া। ২০২২ সালে সিরিয়া সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আল-হায়ার সঙ্গে ইরান ও হিজবুল্লাহরও সম্পর্ক ভালো।
রাজনৈতিক শাখার সাবেক প্রধান হিসেবে মেশালের প্রতি সুরা কাউন্সিল বিশেষ বিবেচনা না দেখালে আল-হায়ারই পদটিতে বসার সুযোগ সবচেয়ে বেশি।
টাইমস অব ইসরায়েল লিখেছে, গাজায় যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দেওয়া হামাসের আরেক নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার মেশালের নীত-দর্শনের কিছুটা বিপরীতমুখী। মেশালকে হয়ত তিনি সমর্থন দেবেন না।
অবশ্য মেশালের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও। তবে ২০১১ সালে আরব বসন্তে সমর্থন দেওয়ার কারণে সিরিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহ তার প্রতি নাখোশ হয়। ২০২১ সালে মেশাল লেবানন সফরে গেলে হিজবুল্লাহ নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি।
ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর বলছে, তবে কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে মেশালের সম্পর্ক ভালো। তাদের দৃষ্টিতে মেশাল কট্টরপন্থি নন, মধ্যপন্থি। তার সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেখে দেশ দুটি।
২০১৭ সাল পর্যন্ত হামাসের নেতা ছিলেন মেশাল। হানিয়ার মৃত্যুর পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস শোক জানাতে মেশালকেই ফোন করেছিলেন।
আলআরাবিয়া বলছে, ইসমাইল হানিয়ার দাফন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দোহায় রয়েছেন মেশাল। দাফন শেষে হওয়ার পর সেখানে হয়ত হামাসের সুরা কাউন্সিলের বৈঠক হতে পারে।
“তবে আল-হায়া ও মেশালের মধ্যে একজনকে হামাসের বেছে নেওয়ার কাজটি এত সহজ নাও হতে পারে,” মনে করছেন আল-মাসরি।
এ ক্ষেত্রে আল-মাসরি আরও একটি নাম বলছেন, সেটি হল জাহের জাবারিন। হানিয়ার অন্যতম এই সহযোগীকে হামাসের অঘোষিত প্রধান নির্বাহী বলা হয়ে থাকে। সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহের কঠিন কাজটি তিনি করে থাকেন এবং ইরানে তার কার্যালয় রয়েছে, যেখানে বসেই তা করেন।
নিউজউইকের খবরে আরেকটি নাম বলা হচ্ছে, তিনি হলেন মুসা আবু মারজুক। ১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা হামাসের পলিটব্যুরোর এই সদস্যকে হানিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে দেখাও যেতে পারে।
এসব নামের মধ্যে মেশালকে হামাসের নতুন নেতা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দেখছেন মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো খালেদ এলিংদি। লন্ডনভিত্তিক মিডল ইস্ট সিকিউরিটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো কারকু ওজসেলিক একই রকম মত দিয়ে বলছেন, মেশালই আবার হামাসের নতুন রাজনৈতিক প্রধান হতে চলেছেন।
২০১০ সালে নিউজইউক মেশালের কাছে জানতে চেয়েছিল হামাসের ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ কবে শেষ হবে। জবাবে তিনি বলেছিলেন, “খুবই সহজ উত্তর। উপনিবেশ আছে তো প্রতিরোধও আছে। উপনিবেশ উঠে যাবে তো প্রতিরোধও থেমে যাবে।”
এত কিছুর পরও খালেদ এলিংদি অবশ্য অন্য একটি সমস্যার কথা বলছেন, আর তা হল- “মেশাল ও মারজুক গাজায় বেড়ে ওঠেনি। গাজার স্থানীয় নেতৃত্ব, স্থানীয় কাঠামোর সঙ্গে তাদের নিবিড় যোগাযোগ না থাকায় তাদের নেতৃত্বের প্রভাব যেখানে কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
“এ ক্ষেত্রে হানিয়া এগিয়ে ছিলেন। তিনি গাজার সন্তান, গাজায় বেড়ে ওঠেন; ২০০৬ সালে ফাতাহর বিরুদ্ধে গাজায় নির্বাচন করে জয়ী হন। কূটনৈতিক কাজের কারণে ২০১৯ সালে হানিয়া বিদেশে অবস্থান শুরু করেন।”
আবু মারজুকের বিষয়ে নিউজইউক লিখেছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ পরিচিত তিনি। হামাসের জন্য তিনি আরব আমিরাতে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের জন্য ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। চরমপন্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হয়ে ২২ মাস জেল খেটেছিলেন, সেখান থেকে জর্ডানে প্রত্যর্পণ করা হয় তাকে।
৭ অক্টোবর অতর্কিতে ইসরায়েলে হামলা চালালে হামাস নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নামেন দেশটির নেতারা। নির্বিচার হামলায় ১০ মাসে ফিলিস্তিনের ৩৯ হাজারের বেশি বাসিন্দাকে হত্যার পরও থামেনি ইসরায়েল। উপরন্তু হামাস ধ্বংস না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার হুংকার দিয়ে যাচ্ছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
দ্য গার্ডিয়ান বলছে, হামাস প্রতিষ্ঠার পর থেকে গুপ্ত হামলা চালিয়ে সংগঠনটির নেতাদের হত্যা করার ইতিহাস রয়েছে ইসরায়েলের। এবারের গাজা যুদ্ধের শুরু থেকে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান হানিয়াকে হত্যায় চেষ্টা চালিয়ে আসছিল দেশটি এবং শেষপর্যন্ত তারা তাতে সফল হয়েছে।
২০০০-এর দশকে হামাসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গাজার মধ্যেই গুপ্ত হামলা চালিয়ে হত্যা করে ইসরায়েল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও আধ্যাত্মিক নেতা আহমেদ ইয়াসিন, সহপ্রতিষ্ঠাতা আবদেল আজিজ আল-রানতিসি, কমান্ডার সালেহ সেহাদেহ।
২০০৭ সালে হামাসের হাতে গাজার নিয়ন্ত্রণ বুঝে পাওয়ার সেই সময়ের নেতা আহমেদ আল-জাবারিকে ২০১২ সালে গাজার ভেতরেই গুপ্ত হামলায় হত্যা করে ইসরায়েল।
দ্য গার্ডিয়ান লিখছে, বারবার নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করলেও প্রতিবারই পুনর্গঠিত হয়ে হামাস ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এবারের নেতৃত্বশূন্যতার গভীরতা বেশ বড়।
বৃহস্পতিবার ইসরায়েল দাবি করে, গত মাসে গাজার খান ইউনিসে তাদের হামলায় হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ নিহত হয়েছেন। হামাসের ডেপুটি সামরিক প্রধান মারওয়ান ইসা মার্চে নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে এক হামলায় নিহত হন বলে ইসরায়েল দাবি করে।
হামাসের নেতাদের হত্যা করতে বড় এক ‘ওয়ান্টেড লিস্ট’ রয়েছে ইসরায়েলের। মোহাম্মদ দেইফের নাম এই তালিকায় দেখা যায় ১৯৯৫ সাল থেকে।
রয়টার্স বলছে, দেইফের মৃত্যুতে সবচেয়ে বড় আঘাত পাওয়ার কথা গাজার বাংকার থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করা সিনওয়ারের।
এখন গাজায় হামাসের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, যুদ্ধবিরতি হবে কিনা, সেসব হামাসের নতুন রাজনৈতিক প্রধানের ওপর নির্ভর করছে বলে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। আর যিনি-ই সংগঠনটির রাজনৈতিক নেতা হোন না কেন, তাকে ইসরায়েলের গুপ্ত হামলা থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা জারি রেখেই গাজার জন্য রাজনীতি ও কূটনীতি করতে হবে।