মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ও অপুষ্টি সঙ্গী করে বাড়ছে শিশু
বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ও অপুষ্টি সঙ্গী করে বাড়ছে শিশু
বিবিসি২৪নিউজ,অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশসহ আফ্রিকা এবং এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে, লোয়ার-রেসপাইরেটরি-ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণে পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ৪০ শতাংশের জন্যই দায়ী বায়ুদূষণ। ২০২১ সালে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১৯ হাজারেরও বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের নগরে অপুষ্টি ও বায়ুদূষণকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠছে শিশু। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ৪০ শতাংশের জন্যই দায়ী বায়ুদূষণ। এ কারণে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও মাইগ্রেনের মতো সমস্যায় ভুগছে শিশুরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা। এ দূষণকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির শিকার। সারা বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ‘অপুষ্টির’ পরই ‘বায়ুদূষণ’।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা পুষ্টিকর খাবার ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চার দেওয়ালে বন্দিজীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর সব স্তরের শিশুরাই শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণে শিশুদের হাঁপানি, অ্যালার্জি, নাক-চোখ ও কানে ইনফেকশন হচ্ছে। এ বায়ুদূষণ দেখে আমাদের সমাজব্যবস্থার প্রতি শিশুদের মনে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তারা আশপাশের পরিবেশকে নোংরা হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা ভার্চুয়াল লাইফে টিভি বা ইউটিউবের মাধ্যমে যে সুন্দর পরিবেশ দেখে বাস্তবে তার সঙ্গে নিজের বেড়ে ওঠা পৃথিবীর মিল পায় না, যখন তারা হীনমন্যতায় ভোগে।
শিশুর অভিভাবক সুরাইয়া আক্তার বলেন, আমার বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে বের হলেই হাঁচি দিতে থাকে, বেশিক্ষণ সড়কে থাকলেই তার চোখ লাল হয়ে যায়। মাস্ক পরিয়ে বাইরে বের করতে হয়। চিকিৎসক জানিয়েছেন, বাচ্চার ডাস্ট অ্যালার্জি আছে। মাস্ক পরিয়ে বাইরে বের করি, কিন্তু এত ছোট বাচ্চা চোখে চশমা পড়তে চায় না। সুরাইয়া বলেন, আমাদের নগরে এত ধুলা যে, বড়দেরই চোখ-নাক জ্বলতে থাকে। সেখানে বাচ্চাদের অবস্থা আরও নাজুক।
অন্য একজন অভিভাবক মোতাহেরা সুলতানা বলেন, বাচ্চাকে খেলতে নিয়ে গেলেও ইনডোরে নিয়ে যেতে হয়। কারণ বাইরে যে ধুলা আর ধোঁয়ার পরিবেশ, তাতে ভেতরে খেলতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কিছু দিন থেকে শুনছি, প্লাস্টিকের খেলনাতেও নাকি বিষাক্ত রাসায়নিক পাওয়া গেছে। আসলে অভিভাবকদের এখন শিশুদের নিয়ে উৎকণ্ঠার যেন শেষ নেই।
বাংলাদেশে শিশুদের ওপর বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রভাব বেড়েই চলেছে। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের (এসওজিএ) ২০২৪ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) থেকে এক প্রতিবেদনে, বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী বাতাসের মানের উদ্বেগজনক অবস্থা তুলে ধরেছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের (এসওজিএ) ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব-পশ্চিম, মধ্য এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার দেশগুলোতে বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। শুধু ২০২১ সালেই বাংলাদেশে ২ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মৃত্যুর কারণ ছিল এই বায়ুদূষণ, যা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। রিপোর্টে আরও উঠে এসেছে যে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বায়ুদূষণজনিত রোগের বেশি শিকার; এর প্রভাবে অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশসহ আফ্রিকা এবং এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে, লোয়ার-রেসপাইরেটরি-ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণে পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ৪০ শতাংশের জন্যই দায়ী বায়ুদূষণ। ২০২১ সালে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১৯ হাজারেরও বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২১ সালে বায়ুদূষণ সম্পর্কিত কারণে বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী ৭ লাখের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়। সারা বিশ্বে এ বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ‘অপুষ্টির’ পরই ‘বায়ুদূষণ’ দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মারা যাওয়া এ শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে; দূষিত জ্বালানি ব্যবহার করে ঘরের ভেতরে রান্না করাই ছিল এ বায়ুদূষণের কারণ।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ রিপ্রেজেন্টেটিভ শেলডন ইয়েট বলেন, লাখ লাখ মানুষেরা, বিশেষ করে শিশুরা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নিম্ন মানের বাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের ওপরই বেশি দেখা যায়; এর প্রভাবে তারা হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। শুধু আজকে আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও বাতাসের গুণমান উন্নত করতে টেকসই সমাধান বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের ডিরেক্টর ফিল্ড অপারেশনস লিমা হানা দারিং বলেন, আমাদের দেশের শিশুরা স্বাভাবিক শৈশব পাচ্ছে না। অপুষ্টি, পরিবেশদূষণ তো রয়েছেই। আমাদের খেলার মাঠগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে। দেশে ১১ লাখ ৫০ হাজার পথশিশু আছে। শিশুশ্রমে জড়িত ১৭ লাখ শিশু। শিক্ষা, চিকিৎসা, সবকিছু থেকেই তারা বঞ্চিত।
স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে অন্যতম প্রধান পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ু ও শব্দদূষণ। বায়ুদূষণের জন্য শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, শিশুদের উচ্চতা মাটির কাছাকাছি। ফলে রাস্তায় চলাচলের সময় গাড়ি থেকে যে কালো ধোঁয়া বের হয়, সেটি শিশুদের বেশি আক্রান্ত করে। শিশুদের ইমিউনিটি সিস্টেম তুলনামূলকভাবে অন্যদের তুলনায় ব্যতিক্রম থাকায় তারা আক্রান্ত হয় বেশি। তাদের ফুসফুস ছোট এবং দুর্বল থাকার কারণে দূষণটা তাদের ফুসফুসের গ্রোথকেও (বৃদ্ধি) বাধাগ্রস্ত করে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণের কারণে দুই ধরনের রোগ শিশুদের হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে হচ্ছে, শ্বাসতন্ত্রীয় অ্যালার্জি, শ্বাসের টান, নিউমোনিয়া, ঘনঘন কাশি, ফুসফুসের প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া। এর পাশাপাশি বায়ুদূষণের কারণে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তার হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তার স্নায়ুর বিকাশ কমে যাচ্ছে। ফলে দেখা যায়, বায়ুদূষণের মধ্যে যারা বড় হয়, তাদের একটি অংশ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুও হয়। এ শিশুরা বড় হয়ে বন্ধ্যত্বের শিকার হয়, ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয় অথবা অ্যাজমাজাতীয় রোগ তাদের বেশি হয়। এ শিশুরা বড় হয়ে যখন সন্তান ধারণ করে, তখন তাদের গর্ভপাতের হার বেড়ে যায়, গর্ভে সন্তানের বৃদ্ধি কম হয়, বিকলাঙ্গতা বৃদ্ধি পায়। এভাবে আমরা বলতে পারি, যে শিশুরা বায়ুদূষণের মধ্যে বেড়ে ওঠে, তাদের শ্বাসতন্ত্রীয় অসুখ বেশি হয় ও ধীরে ধীরে তাদের শ্বাসতন্ত্রীয় অঙ্গগুলো বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয় এবং তাদের প্রত্যেকটি কার্যকারিতা হারায়।