বুধবার, ৯ আগস্ট ২০২৩
প্রথম পাতা » জেলার খবর | প্রিয়দেশ | বিশেষ প্রতিবেদন | শিরোনাম | সাবলিড » চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ পার্বত্য জেলাগুলো ভারী বর্ষণে বিপর্যস্ত
চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ পার্বত্য জেলাগুলো ভারী বর্ষণে বিপর্যস্ত
বিবিসি২৪নিউজ,অনলাইন ডেস্ক: ভারী বর্ষণে বিপর্যস্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ পার্বত্য জেলাগুলো। এসব জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার হ্রদ, নদী ছড়ার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বহু এলাকা তলিয়ে গেছে।
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বন্দরনগরীর পাশাপাশি চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি। প্রবল বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। একই অবস্থা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিরও।
দুর্ঘটনা এড়াতে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ভূমিধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বিস্তৃর্ণ এলাকায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুই জেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
অতিবৃষ্টিতে বন্যা এবং জলাবদ্ধতার কারণে বুধবার ও বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। মঙ্গলবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান।
ভয়াবহ বন্যায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়াসহ আরও সাতটি উপজেলা নিমজ্জিত। এ ছাড়াও চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার নিম্নাঞ্চলের গ্রামীণ সড়কগুলো ডুবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দোহাজারী পৌরসভার রায়জোয়ারা, দিয়াকুল, কিল্লাপাড়া, জামিজুরী, পূর্ব দোহাজারী, চন্দনাইশ পৌরসভা, বরকল, বরমা, কাঞ্চনাবাদ, জোয়ারা, হাশিমপুর, সাতবাড়িয়া ও ধোপাছড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমে বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের কসাইপাড়া, সাতকানিয়ায় কেরানিহাট ও আশপাশের এলাকা এবং লোহাগাড়া উপজেলার কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। একারণে এই মহাসড়ক দিয়ে যানবাহন চলতে পারছে না। বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটি ট্রাক হয়তো চলাচল করছে।
জানা গেছে, বান্দরবান থেকে নেমে আসা সাংগু ও ডলু নদীর ঢল এবং কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক ডুবে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। ডুবে গেছে একতলা বাড়িও। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা এবং নেটওয়ার্ক সমস্যা তৈরি হওয়ায় ওই এলাকার লোকজন মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েছেন।
তিন উপজেলার মধ্যে সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া, বাজালিয়া, ঢেমশা, সদর ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সোনাকানিয়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া লোহাগাড়ার পদুয়া ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা এবং চন্দনাইশের ধোপাছড়ি ও দোহাজারী পৌরসভার আশেপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েক লাখ মানুষ গত দুদিন থেকে পানিবন্দি। ফসলি জমিও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পুকুরের মাছও বানের বানিতে ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে হাতে কোনো কাজ নেই ন আয়ের মানুষের।
টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। গত সোমবার রাতের পর থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদী ও খালের বেড়িবাঁধ ঢলের পানি ঢুকে পড়ছে গ্রামে।
জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, রামু সদর উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের ৯০ গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এতে এসব এলাকার দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার বিকালে জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, জেলায় এ পর্যন্ত ৯টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আর গত দুই দিনে পাহাড় ধস ও পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে ও পাহাড় ধসে শিশুসহ দুইদিনে ৫ জন নিহত হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোরে ভূমি ধস ও বাড়ির দেয়াল ভেঙে চাপা পড়ে রোজিনা আক্তার (৫০) নামে এক মহিলা নিহত হয়েছেন। নিহত রোজিনা ওই গ্রামের আবুল হোসেনের স্ত্রী।
একই দিন দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড কোরালখালী গ্রামে মোহাম্মদ সেলিম প্রকাশ সেলিম খলিফার ১২ বছরের এক মেয়ে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। একই পরিবারের আরও একটি মেয়ে পানিতে ভেসে গিয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছে।
আগের দিন সোমবার (৭ আগস্ট) সকালে উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সবুজ পাড়া (বরঘোনা) এলাকায় পাহাড় ধসে দেওয়াল চাপা পড়ে দুই শিশু মৃত্যু হয়েছে। নিহত শিশুরা হলো মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের পুত্র তাবাচ্ছুম (১) ও মোহাম্মদ সাবিদ (৫)।
এদিকে মাতামুহুরী নদী ও বাকখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের তোড়ে মাতামুহুরি নদীর কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এসব ভাঙর দিয়ে লোকালয়ে ঢলের পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মাতামুহুরি নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রবল বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানও। রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের সঙ্গে এই জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টানা বর্ষণে বেড়েছে সাঙ্গু ও মাতামুহুরীর পানি। প্লাবিত হয়েছে হোটেল–রিসোর্ট। সেখানে আটকা পড়েছেন অনেক পর্যটক।
বান্দরবান সদর, রুমা, আলীকদমসহ জেলার বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলায় দুই শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গত সোমবার ও মঙ্গলবার ভূমিধসে মা ও মেয়েসহ তিনজন নিহত ও আহত হয়েছেন ৬ জন।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, মঙ্গলবার সকালে লামা উপজেলার কুমারীতে বাড়ির ওপর মাটির টুকরো ধসে নুরুল ইসলাম (৩৫) নামের একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬ জন। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাদের মধ্যে চারজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তাসলিমা সিদ্দিকা জানান, সদর উপজেলায় ৪৬টি, লামায় ৫৫টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৪৫টি, রুমায় ২১টি, রোয়াংছড়িতে ১৯টি, আলীকদমে ১৫টি, থানচিতে ৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর নাব্য কমে যাওয়া এবং নদীতীরবর্তী এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা প্রধান শহর, উপজেলা শহর এবং জনবসতিপূর্ণ গ্রামগুলো অল্প বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়।
লামার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, টানা বৃষ্টিতে সময় যত গড়াচ্ছে, পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। আলীকদম-লামা হয়ে কক্সবাজারের চকরিয়া পর্যন্ত সড়কে বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। ফলে ওইসব এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
মাইনী নদী ও চেঙ্গী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ভারী বর্ষেণ খাগড়াছড়ি জেলা শহরের শালবন, কলাবাগান ও সবুজবাগ ছাড়াও মাটিরাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসেরর ঘটনা ঘটেছে। ভারী বর্ষণের কারণে নদীর পানির প্রবল স্রোতে দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের জাতমলী বেইলি সেতুর একপাশের মাটি সরে গিয়ে দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই যানচলাচল বন্ধ হলে বেইলি সেতুর দু’পাশে ছোট-বড় যানবাহন আটকা পড়ে যায়। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি দুর্ভোগে পড়েছে দু’পাড়ের মানুষ।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ঘনশ্যাম ত্রিপুরা মানিক বলেন, ভারী বৃষ্টির কারণে প্রবল স্রোতে জামতলী বেইলি সেতুর একপাশের ভরাট কৃত মাটি সরে গিয়ে সেতুটি যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। স্থানীদের সহযোগিতায় যানচলাচল স্বাভাবিক করতে কাজ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে টানা বর্ষণের ফলে রাঙামাটির ১০ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কাপ্তাইয়ে মাটি ধসে কয়েকটি বসতঘর ধসে পড়েছে। রাইখালী রিফিউজি পাড়া, বড় ঝিরিপাড়া ও রাইখালী বাজার এলাকায় পাহাড় ধসে অনেকের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন।
বৃষ্টির কারণে রাজস্থলী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও বহু মাছের প্রজেক্ট এবং পুকুর পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন স্থানের রাস্তা-ঘাট, পুকুর-জলাশয়।
জুরাছড়ি উপজেলার বেশ কয়েকটি নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাঘাইছড়ি উপজেলার বেশ কয়েকটি নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত লোকজন।
পাহাড়ের ঝুঁকিতে থাকা ও পানিবন্দি লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে প্রশাসন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান।