সোমবার, ১০ অক্টোবর ২০২২
প্রথম পাতা » পরিবেশ ও জলবায়ু | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড | স্বাস্থ্যকথা » মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অর্জন ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা
মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অর্জন ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা
বিবিসি২৪নিউজ,স্বাস্থ্য ডেস্কঃ মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার তার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং ভিশন ২০২১-এ মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মানসিক সুস্বাস্থ্য বলতে শরীর ও মনের এমন একটি ভারসাম্য বোঝায়, যখন আমরা সার্বিকভাবে ভালো বোধ করি। জীবনে চলার পথে যেসব বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা আসে, আমরা সেগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হই এবং এর পরেও সহজেই মনের সুখ, শান্তি ও আনন্দ খুঁজে নিতে পারি। যদিও অনেকের জন্যই এ ধরনের প্রতিকূল সময় বেশ দীর্ঘ হয়। প্রিয়জনকে হারানো, ক্যান্সার বা হৃদরোগের মতো দুরারোগ্য কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া, পরিবার/ঘর/চাকরি হারানো কিংবা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার যে অনুভূতি– এগুলো অনেক সময়ই সামলে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন আরও অনেক প্রতিকূলতা আমাদেরকে তীব্র মানসিক চাপের দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং তখন দৈনন্দিন জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটা কঠিনতর হয়ে ওঠে। আর এ ধরনের অবস্থা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে ও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না হয়, তখন এগুলো আমাদেরকে আরও জটিল ব্যাধি– যেমন মানসিক রোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সংজ্ঞা অনুসারে স্বাস্থ্য হলো “শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে ভালো বোধ করার অনুভূতি; কেবল রোগ বা জরাগ্রস্ততার অনুপস্থিতিই সুস্বাস্থ্য নয়”। অধিকাংশ মানুষই প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন। কিন্তু যারা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না তাদের অনেকের অভিজ্ঞতাই বাস্তবতা থেকে সরে আসতে থাকে। তারা বিভ্রম (delusion), অসহনীয় দুঃখবোধ, নিয়ন্ত্রণহীন রাগ, সুতীব্র ভয় কিংবা কাল্পনিক ও অলীক অভিজ্ঞতার (hallucinations) মধ্য দিয়ে যেতে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর মোট প্রতিবন্ধিতার এক তৃতীয়াংশের কারণ হলো মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, মাদকদ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগ, আত্মহত্যা এবং স্মৃতিভ্রংশের (dementia) মতো স্নায়বিক রোগ। বছরজুড়ে বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ এসব সমস্যায় ভোগে (Virgo et al., 2016)। উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় ধরনের দেশগুলোতেই মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব এবং মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কারণে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক ভার ক্রমবর্ধমান হারে স্বীকৃতি পাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এমন মানুষদের ৮০ শতাংশেরও বেশি এখনও মানসম্মত এবং সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবার সুযোগের বাইরে থাকছেন। আত্মহত্যা, একসাথে একাধিক স্বাস্থ্যসমস্যা থাকা বা চলমান শারীরিক অসুস্থতার ফলে মৃত্যু হওয়ার হার অনেক বেশি, যার পেছনে অবহেলা ও অজ্ঞতা অনেকাংশেই দায়ী। ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখের মতো মানুষ মানসিক রোগজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে, যা বৈশ্বিক মৃত্যুহারের ১৪.৩ শতাংশ।
মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার তার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং ভিশন ২০২১-এ মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একই সাথে গুণগত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি বিস্তৃত কাঠামো তৈরি করেছে, যেন তা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন স্তরগুলোতে বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। স্বাস্থ্য যে শুধু শারীরিক সুস্থতার জন্য নয় বরং অর্থনৈতিক জীবিকার জন্যও অপরিহার্য– ওই বিষয়টি এ পরিকল্পনায় প্রাধান্য পেয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তার ৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর ব্যাপ্তিকাল ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর জুন পর্যন্ত। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে রয়েছে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আওতায় সুশাসন আরও শক্তিশালী করা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, সেবার গুণগত মান উন্নয়ন ও সেবা গ্রহণের সুযোগের বিস্তার ঘটানো। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচিতে মানসিক স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।লক্ষ্যণীয় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মধ্যে যারা সর্বপ্রথম মানসিক স্বাস্থ্যকে শীর্ষ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে স্থান দিয়েছে, তাদের মাঝে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচিগুলো সময়ের সাথে সাথে বেশ কয়েক ধাপে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে একটি নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণীত হয় এবং মানসিক স্বাস্থ্য নীতি চূড়ান্ত করার কাজটিও চলমান রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং যারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, এমন মানুষদের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতির ওপর একটি সার্বিক বিশ্লেষণ করার পরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য আইনে যে বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো– মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে রয়েছে এমন নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করা, তাদেরকে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা এবং পুনর্বাসন ব্যবস্থা করা। এ আইনে ৩১টি ধারা রয়েছে, যা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় তদারকি করতে ভূমিকা রাখবে। একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা তৈরি এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে কীভাবে সামগ্রিক রূপকল্প এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা প্রদান ও এ বিষয়ক কর্মসূচিসমূহকে গুরুত্ব প্রদান করা সম্ভব, ওই বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা ২০১৯-এ সার্বিক নির্দেশনা রয়েছে। যদিও এই নীতিমালা এখনও পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে, এতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত জ্ঞান ও চর্চাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে– বিশেষ করে যেগুলো আনুষঙ্গিক ও উপযোগী এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক চিন্তাধারার মধ্যে সমন্বয় করেছে। এই নীতিমালা বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই স্বাস্থ্যখাতের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অর্থসংকটের পাশাপাশি সুপরিকল্পিত কাঠামোর ক্ষেত্রেও ঘাটতি রয়েছে। এর পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো কীভাবে মনোরোগের ক্ষেত্রে সেবা দিতে হবে সে ব্যাপারে ধারণা ও দক্ষতার ঘাটতি, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কুসংস্কার ও ভুল ধারণা এবং মনোরোগের ধরন অনুযায়ী জটিলতা। বাংলাদেশেও এ পরিস্থিতি খুব একটা ভিন্ন কিছু নয়। এখানেও অনেক বছর ধরেই স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেক কম প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে এবং টেকসই সমাধানের জন্য সকল খাতের সমন্বয়ে একটি বিস্তৃত ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা নীতি’ প্রণয়ন করাটা অপরিহার্য যেন দেশজুড়ে মানসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।সায়মা ওয়াজেদ, একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্কুল সাইকোলজিস্ট; বর্তমানে ব্যারি ইউনিভার্সিটির স্কুল সাইকোলজি বিভাগে ক্লিনিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে নিয়োজিত আছেন; একইসাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের অটিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলের সদস্য; ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এর ‘ভালনারেবিলিটি’ বিষয়ক শুভেচ্ছাদূত; অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারস বিষয়ক বাংলাদেশের জাতীয় এডভাইজরি কমিটি এবং সূচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন।