মঙ্গলবার, ৩১ মে ২০২২
প্রথম পাতা » প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » প্রধানমন্ত্রীর জমি অধিগ্রহণ করেছে -সরকার
প্রধানমন্ত্রীর জমি অধিগ্রহণ করেছে -সরকার
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশের টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হয়ে রংপুর পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের সাড়ে ২৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। সাসেক-২ নামের এই প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের জমি পাওয়া গেলেও সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি মালিকানার ভূমি অধিগ্রহণে ধীরগতিতে কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ সূত্রে রংপুরের পীরগঞ্জের জমির মালিক হয়েছেন শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তাঁদের জমির ওপর দিয়ে যাচ্ছে মহাসড়ক। দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (সাসেক-২) প্রকল্পের আওতায় ধীরগতির যান চলাচলে দুই পাশে সার্ভিস লেনসহ ১৯০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ চলছে। ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর একনেকে অনুমোদিত এ প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ইতোমধ্যে ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি হয়েছে।
প্রকল্পের জন্য ৩২৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ছয় বছরে অধিগ্রহণ করা গেছে ২৭০ হেক্টর। ৫৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ আটকে আছে নানা জটিলতায়। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সরকারি সংস্থা তুলা উন্নয়ন বোর্ডের জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় ফ্লাইওভারের কাজ আটকে আছে।
গত ২৫ মে সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিএসসি) সভায় বলা হয়েছে, গোবিন্দগঞ্জে ভূমি অধিগ্রহণে ধীরগতির কারণে ফ্লাইওভারের ঠিকাদারকে জমি বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দেরির কারণে ঠিকাদার ইতোমধ্যে বাড়তি টাকা দাবি করেছেন।
সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণের জমির বিষয়টি সমাধান হয়েছে।প্রধানমন্ত্রীর জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি জানা নেই জানিয়ে সচিব বলেন, ‘উন্নয়ন অগ্রগতির প্রেরণা প্রধানমন্ত্রী নিজেই। তাঁর জমি অধিগ্রহণে বাধা থাকার কথা নয়। সে কারণেই আমারও জানা নেই।’ পিএসসি সভায় বলা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন বারবার ভূমির শ্রেণি ও স্থাপনার ধরন পরিবর্তন করছে। সম্পূরক প্রাক্কলন পাঠাচ্ছে। এতে একদিকে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসন প্রাক্কলনকৃত টাকা পরিশোধ না করায় অধিগ্রহণকৃত জমির স্থাপনা উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। এতে প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
সওজ সূত্র জানিয়েছে, জেলা প্রশাসনের গাফিলতিতে জমি নিয়ে বেগতিক অবস্থা। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের জমি অধিগ্রহণেও নারাজ ছিল জেলা প্রশাসন। সরকারপ্রধানের জমিতে হাত দিতে আমলারা ভয় পাচ্ছিলেন। মহাসড়ক ঘুরিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। পরবর্তী সময়ে রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে বিষয়টি জানায় সাসেক-২ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর জমি অধিগ্রহণের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবার এমনই। তাঁরা দেশের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।
স্পিকার জানান, প্রয়াত ওয়াজেদ মিয়ার জমির সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তাঁর দুই সন্তানের আবেগ জড়িত হলেও প্রধানমন্ত্রীকে জানানো মাত্রই তিনি বলেছেন, ‘সবার জমি অধিগ্রহণ হলে, আমারটা কেন হবে না? রাস্তার জন্য সাধারণ মানুষের জমি নেওয়া হচ্ছে, আমার জমি সবার আগে নেওয়া হোক।’
সওজ সূত্রে জানা গেছে, পীরগঞ্জের ফতেহপুর বুজরুক মৌজার চার নম্বর দাগে ছয় শতাংশ এবং পাঁচ নম্বর দাগে আট শতাংশ বাণিজ্যিক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে ওয়ারিশসূত্রে এই জমির মালিক হয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
কিশোরগাড়ী মৌজার এক হাজার ১০১ নম্বর দাগে ১৫ শতাংশ বাণিজ্যিক জমি ওয়াজেদ মিয়া এবং তাঁর তিন ভাই আবদুল জলিল মিয়া, আবদুল খালেক মিয়া ও আবদুল ওয়াহেদ মিয়ার নামে এসএ রেকর্ড হয়েছে। এ জমির ছয় শতাংশ মহাসড়কের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যার দেড় শতাংশের মালিকানা ছিল ওয়াজেদ মিয়ার। তাঁর মৃত্যুর পর এর দুই আনার মালিকানা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাকি অংশের মালিকানা পেয়েছেন তাঁদের দুই সন্তান।
এ ছাড়া বাজিতপুর মৌজার ৮০৯ নম্বর দাগে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের আরও ১১ শতাংশ ডাঙ্গা (কৃষি) জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এডব্লিউএম রায়হান শাহ জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ছেলেমেয়ের মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, দুই লাখ ৭৯ হাজার টাকা শতাংশ দরে সাড়ে ১৫ শতাংশ বাণিজ্যিক জমির জন্য ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ এবং ৭৫ হাজার টাকা দরে ১১ শতাংশ কৃষি জমির জন্য আট লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে। শেখ হাসিনা নিজ নামে পেয়েছেন ৫২ হাজার ৩১২ টাকা ক্ষতিপূরণ। তাঁদের ক্ষতিপূরণের চেক জেলা প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের চাচাত ভাই তাজিমুল ইসলাম শামীম বলেন, শেখ হাসিনা, জয়, পুতুলসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।অবশ্য প্রশাসনের গাফিলতির কারণে কেউ কেউ এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি। পীরগঞ্জের সরকারি শাহ আবদুর রউফ কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাইফুল নেওয়াজ শাকিলের দশমিক ৪৮ শতাংশের একটি দোকান অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনি জানান, শতাংশ প্রতি ১৮ লাখ টাকা হিসেবে তিনি আট লাখ ৬৪ হাজার টাকা পাওনা। তবে মামলার কারণে টাকা পাচ্ছেন না।
পীরগঞ্জ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাশেদুন নবী রাশেদ জানান, তাঁর পরিবারের সাড়ে আট শতাংশ জমির টাকা এখনও পাননি। তিনি বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ শাখা ঘুষটুষ চায়নি। কিন্তু খালি ঘুরায়। কেন যে ঘুরায় বুঝি না।’ রাশেদের ভাষ্য, তাঁর প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের অনেকেরই জমি গেছে। কাগজে ঝামেলা নেই। তবু ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না।
আইন অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণ করে দেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত জমি ও স্থাপনার মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়। সরকার নতুন আইনে অধিগ্রহণকৃত জমির মৌজা মূল্যের তিনগুণ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয় মালিকদের। জমিতে থাকা স্থাপনার দামও দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির অন্যতম খাত ভূমি অধিগ্রহণ। দেশের বিশিষ্ট একজন অর্থনীতিবিদ আলাপচারিতায় সমকালকে জানান, সাসেক-২ প্রকল্পে এলেঙ্গায় তাঁর জমি নেওয়া হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ শাখা ক্ষতিপূরণের টাকার আট শতাংশ ঘুষ দাবি করেছে। ওই অর্থনীতিবিদ আইনজীবীর মাধ্যমে জানান ঘুষ দাবির অভিযোগ দুদকে জানাবেন। তখন তাঁকে জানানো হয়, ১২ শতাংশ ঘুষ দিতে হবে। চার শতাংশ দুদকে অভিযোগ দেওয়ার হুঁশিয়ারির শাস্তি!
গত রবি ও সোমবার দফায় দফায় চেষ্টা করেও রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসানের বক্তব্য জানতে পারেনি। গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান বলেন, মালিকানা নিয়ে সমস্যার কারণে অধিগ্রহণে বিলম্ব হয়। আবার একই জমির ভিন্ন ভিন্ন দলিলেই একাধিক শ্রেণি উল্লেখ রয়েছে। নিম্নদর নির্ধারণ করলে মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উচ্চ শ্রেণির দর নির্ধারণ করলে সরকারের ক্ষতি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, গাইবান্ধার ভূমি অধিগ্রহণে সামান্যতম দুর্নীতির অভিযোগ ও সুযোগ নেই।সওজ প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জমি নির্বিঘ্নে অধিগ্রহণ করা গেছে। কিন্তু অন্যদের জমি না পাওয়ায় কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তবে বিষয়টি সওজের হাতে নেই। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত জমি বুঝে পেতে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সরকারি সংস্থার জমি পেতে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
গত ২৪ মে পর্যন্ত সাসেক-২ প্রকল্পের অগ্রগতি ৫০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। ২০২১ সালের আগস্টে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিল। নতুন লক্ষ্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করা। কিন্তু সওজ সূত্র সমকালকে বলেছে, এ লক্ষ্য অর্জিত হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।