রবিবার, ২০ মার্চ ২০২২
প্রথম পাতা » আর্ন্তজাতিক | পরিবেশ ও জলবায়ু | শিরোনাম | সাবলিড » নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রাশিয়াকে ‘চাপে ফেলছে’ চীন
নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রাশিয়াকে ‘চাপে ফেলছে’ চীন
বিবিসি২৪নিউজ,আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ইউক্রেইনে যুদ্ধ বাঁধিয়ে পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রাশিয়ার অর্থনীতি থেকে চীন কি নীরবে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে?
সিএনএনের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে এমন ধারণাই দেওয়া হয়েছে। আর কী কী ভা্বে চীন রাশিয়ার অর্থনীতির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছে, তার চারটি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
সিএনএন লিখেছে, রাশিয়া ইউক্রেইনে সেনা পাঠানোর আগের মাসেই ‘সীমাহীন বন্ধুত্বের’ ঘোষণা দিয়েছিল মস্কো ও বেইজিং। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের অবরোধের মধ্যে থাকা রাশিয়ার অর্থনীতিকে সহায়তা করার ব্যাপাবে চীনের আগ্রহ ও সুযোগে ভাটা পড়েছে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা না করলেও চীন অবরোধ এড়িয়ে চলার পথে রয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বারবারই বলে আসছে, সংকট সমাধানে অবরোধ আরোপ কার্যকর কোনো উপায় নয়, বরং তা নতুন সংকট সৃষ্টি করে।
মঙ্গলবার স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপের সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, “চীন কোনোভাবে এ সংকটের অংশীদার নয়, এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা চীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করুক তা আমরা চাই না।”
ইউক্রেইনে চীনা রাষ্ট্রদূতের একটি বক্তব্যকে বুধবার বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়, যেখানে লভিভে অবস্থানরত রাষ্ট্রদূত ফান চিয়ানরং এ সপ্তাহের শুরুতে বলেছিলেন, “চীন কখনোই ইউক্রেইনকে আক্রমণ করবে না। আমরা সহায়তা করে যাব, বিশেষ করে আর্থিকভাবে।”
তার ওই বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারেও প্রকাশ করে লভিভের আঞ্চলিক সরকার।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় চীনের কোম্পানিগুলো অবরোধের মুখে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় সাম্প্রতিক দিনগুলোতে চীনের শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়েছে। বুধবার এই দরপতন বন্ধ হয় যখন বেইজিং প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা তাদের এই অস্থির অর্থনীতিকে আরও স্থিতিশীল রাখতে ‘প্রয়োজনীয় নীতি’ অবলম্বন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তাদের কাছে তথ্য আছে যে রাশিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা করার অনুরোধ রাখার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। বেইজিং অবশ্য এসব তথ্যকে ‘ভুয়া’ খবর বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে সিএনএন লিখেছে, চীন একটি ‘সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার’ চেষ্টা করছে। একদিকে তারা রাশিয়ার সঙ্গে কথা দিয়ে সমর্থন দিচ্ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও খেপিয়ে তোলা থেকে বিরত থাকতে চাইছে।”
পশ্চিমাদের মোকাবিলার জন্য কৌশলগত স্বার্থে একই অবস্থানে রয়েছে বেইজিং ও মস্কো। যদিও চীনের ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলারের প্রবেশাধিকার হারানোর ঝুঁকি নিতে পারবে না এবং অনেক চীনা শিল্প খাত যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে চলতে পারবে না।
রাশিয়া চীনের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার হলেও বেইজিংয়ের আরও অগ্রাধিকার রয়েছে। গত বছরের চীনের শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমান চীনের মোট বাণিজ্যের মাত্র ২ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের হার এর চেয়ে অনেক বেশি।আর সে কারণেই গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ার চাপে পড়া অর্থনীতি থেকে বেইজিং নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে বলে তুলে ধরা হয়েছে সিএনএন এর প্রতিবেদনে।
রুবলের দরপতনে চীন যা করেছে
চীনের মুদ্রা ইউয়ান মুক্তভাবে লেনদেন হয় না, বরং পিপলস ব্যাংক অব চায়নার (পিবিওসি) বেধে দেওয়া ব্যান্ড বা পরিধির মধ্যে ইউয়ানের লেনদেন করতে হয়। গত সপ্তাহে তারা রুবলের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়ের ব্যান্ড বা পরিধি দ্বিগুণ করেছে, যা রুবলের দরপতনকে ত্বরাণ্বিতই করেছে।
ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরুর পর ডলার ও ইউরোর বিপরীতে রুবল এরইমধ্যে ২০ শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে। ইউয়ানের বিপরীতেও রুবলের দরপতন হতে দিয়ে মস্কোর কোনো উপকার চীন করেনি।
চীন থেকে আমদানি করা স্মার্টফোন, ও গাড়ির জন্য রুশদেরকে এখন বেশি রুবল খরচ করতে হবে। রাশিয়াতে চীন কোম্পানি শাওমি ও হুয়াওয়ের ফোন খুবই জনপ্রিয়। যুদ্ধ শুরুর আগে বিশ্ব বাজারে তারা শীর্ষস্থান নেওয়ার জন্য অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিল।
চীনের গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি গ্রেট ওয়াল মোটর ও গিলি অটো রাশিয়ার গাড়ির বাজারের ৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে, গত বছর তারা সেখানে এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি গাড়ি বিক্রি করেছে। মুদ্রা বিনিময় হার ওঠানামা করায় গ্রেট ওয়াল মোটর রাশিয়াতে নতুন গাড়ি সরবরাহ স্থগিত রেখেছে।
চায়না বিজনেস নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, রুবলের দরের ব্যাপক উত্থানপতন সামাল দিতে ইউয়ানের ব্যান্ড বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চীনা রপ্তানিকারকদের সহায়তা করবে। বর্তমানে চীন-রাশিয়া বাণিজ্যে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ লেনদেন হয় ইউয়ানে।
রাশিয়ার রিজার্ভ নিয়ে বসে আছে চীন
ন্যাটিক্সিসের এশিয়া-প্যাসিফিকের প্রধান অর্থনীতিবিদ আলিসিয়া গারসিয়া মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, রাশিয়াকে সহযোগিতা করতে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে প্রস্তাবটি চীন দিতে পারত, তা হল, বেইজিংয়ের কাছে মস্কোর গচ্ছিত ৯ হাজার কোটি ডলারের রিজার্ভ, যা ইউয়ানে রাখা রয়েছে, তা ব্যবহার করতে দেওয়া।
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার ৩১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে গেছে, যা তাদের মোট রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশটির অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানোভ এ সপ্তাহে জানিয়েছেন, মস্কো যেহেতু ডলার ও ইউরোর রিজার্ভ ব্যবহার করতে পারছে না, তাই তারা ইউয়ানের রিজার্ভ ব্যবহার করতে চায়।
তবে রাশিয়ার ওই রিজার্ভের বিষয়ে চীন এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।
গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, “চীন তাদের কাছে থাকা মস্কোর রিজার্ভ ডলারে বা ইউরোতে ব্যবহার করার সুযোগ দিলে তা স্পষ্টই রাশিয়াকে এই অবরোধে ধাক্কা সামলাতে সহায়তা করবে। যদিও তাতে পশ্চিমা অবরোধ ভাঙার ঝুঁকি নেওয়া হবে চীনের জন্য, আর সেটা এখন তাদের জন্য স্বাভাবিকও নয়।”
রাশিয়াকে উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ দিচ্ছে না চীন
নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রধান দুই বিমান নির্মাতা বোয়িং ও এয়ারবাস রাশিয়ার বিমানগুলোর জন্য স্পেয়ার পার্টস পাঠাতে পারবে না। একই ঘটনা ঘটেবে জেট ইঞ্জিন নির্মাতাদের ক্ষেত্রে।এর অর্থ হচ্ছে, রাশিয়ার বিমানগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যন্ত্রাংশ সংকটে পড়বে বা যন্ত্রাংশ না বদলেই প্লেন ওড়াতে থাকবে যা নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
শীর্ষ রুশ কর্মকর্তারা এ মাসের শুরুতে জানান, উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ সরবরাহে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চীন। মস্কো এখন বিকল্প খুঁজছে।
রাশিয়ার এয়ার ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির প্রধান ভ্যালেরি কুদিনোভ বার্তা সংস্থা তাসকে বলেন, “যতটুকু আমি জানি … চীন আমাদের যন্ত্রাংশ দিতে পারছে না।”
সিএনএন লিখেছে, এ বিষয়ে তারা চীনের মন্তব্য জানতে চাইলে সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বেইজিং যে কোনো অবরোধের বিপক্ষে এবং চীন ও রাশিয়া নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা চালিয়ে যাবে।
রশিয়ার অবকাঠামোতে বিনিয়োগ আটকে গেছে
ইউক্রেইনে সামরিক অভিযানের কারণে রাশিয়া ও বেলারুশে চলমান সব প্রকল্প স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক। ২০১৪ সালের পর বিশ্ব ব্যাংক রাশিয়ার জন্য নতুন কোনো ঋণ বা বিনিয়োগ অনুমোদন করেনি এবং বেলারুশের জন্য এটা বন্ধ আছে ২০২০ সাল থেকে।
অবাক করার মত বিষয় হল, চীন-ভিত্তিক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকও (এআইআইবি) একই পদক্ষেপ নিয়েছে। এ মাসের শুরুতে দেওয়া এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তারা রাশিয়া ও বেলারুশে তাদের সব কার্যক্রম স্থগিত করেছে।
ব্যাংকের ‘স্বার্থ সুরক্ষার’ জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে এআইআইবির বিবৃতিতে জানানো হয়।
এআইআইবির এই সিদ্ধান্তের অর্থ হল, রাশিয়ার সড়ক ও রেলের উন্নয়নে অনুমোদন পাওয়া ও প্রস্তাবিত ১১০ কোটি ডলার এখন আটকে গেল।