বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের যত চ্যালেঞ্জ
ড. আরিফুর রহমানঃ বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের গোড়ার গলদগুলো চিহ্নিত করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা যেমন মানা হচ্ছে না, তেমনি নানা ফাঁকফোকর ও ত্রুটি রেখেই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। উপরন্তু প্রাক্কলিত দর নির্ধারণেও বিস্তর গরমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে কেবল প্রকল্পের ব্যয় ও সময়ই বাড়ছে না, কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, যা মোটেই কাম্য নয়। সম্প্রতি আইএমইডির এক প্রতিবেদনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে অন্তত ২৬ ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প তৈরি ও অনুমোদন পর্যায়ে ৯টি, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে ১৩টি এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন-পরবর্তী পর্যায়ে ৪টি চ্যালেঞ্জ।
প্রকল্পের অনুমোদন পর্যায়ে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা হলো-অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও সুবিধাভোগীদের মতামত বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্প হাতে নেওয়া; ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প দলিল বা ডিপিপি; ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের আগেই সম্ভাব্য ভূমি চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসকদের সম্মতি না নেওয়া; প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য স্থাপনা পরে রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্কার, ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকা; মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) আর্থিক সীমা না মেনে প্রকল্প গ্রহণ; নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত প্রকল্প টেকসই করার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা বা শর্ত না থাকা; প্রকল্প গ্রহণে আঞ্চলিক বৈষম্য বিবেচনায় না নেওয়া; কাজ শুরুর পর মহলবিশেষকে সুবিধা দিতে প্রকল্পের ভৌত কাজের নকশা পরিবর্তন ও বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত না করে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া।
অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে ১৩ চ্যালেঞ্জের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ও টিপিপির (কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব) কর্ম ও ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা; মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়নে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা; প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব; নিয়মিত পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) ও স্টিয়ারিং কমিটির সভা আয়োজন না করা; ক্রয় কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি।
এছাড়া প্রকল্পের বাস্তবায়ন-পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে-প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে পিসিআর (প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন) আইএমইডিতে না দেওয়া; পিসিআর তৈরিতে নির্দিষ্ট ছক অনুসরণ না করা; প্রকল্প শেষে অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ বা রক্ষণাবেক্ষণ না করা; সংস্থায় দক্ষ জনবল না থাকা এবং এর ফলে প্রকল্প শেষে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সেবা ক্রয় চুক্তি করা ও প্রকল্প শেষে বাস্তবায়িত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজস্ব বাজেটের অপ্রতুলতা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সঠিকভাবে সম্পন্ন না হলে সেই ভুলের মাশুল প্রকল্পের পুরো সময় বহন করতে হয়। অতএব এ কাজটি অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে এবং তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করা উচিত। একই সঙ্গে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিবিড় তদারিক নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অন্যথায় কথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জনজীবনে দুর্ভোগের প্রতিচিত্র হিসাবে বিবেচিত হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠা জরুরি। চ্যালেঞ্জগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণে গুরুত্ব আরোপ করা হবে, এটাই প্রত্যাশা।