শুক্রবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২
প্রথম পাতা » সম্পাদকীয় » বিচ্ছিন্নতাবোধ সামাজিক অবক্ষয়েরই প্রতিচিত্র -একটি ব্যতিক্রমী আত্মহত্যা
বিচ্ছিন্নতাবোধ সামাজিক অবক্ষয়েরই প্রতিচিত্র -একটি ব্যতিক্রমী আত্মহত্যা
এম ডি জালালঃ সাম্প্রতিক রাজধানী ঢাকায় এক ব্যতিক্রমী আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর আবু মহসিন খান ৫৮ বছর বয়সে ফেসবুক লাইভে তার ব্যক্তিজীবনের নানা হতাশার কথা শেষ করে পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন।
ক্যানসারে আক্রান্ত মহসিন খান ফেসবুক লাইভে বলেন, তার জীবনের অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই তিনি লাইভে এসেছেন। তিনি বলেন, তিনি সম্পূর্ণ একা। তার এক খালা মারা যাওয়ার পর তার মনে এমন ভয় জন্মেছে যে, তিনিও মারা যাবেন এবং তিনি এতই একা যে, তার ফ্ল্যাটে তার মৃতদেহের খবর এক সপ্তাহ কেউ জানতে পারবে না।
ফেসবুকের অডিয়েন্সকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন-ছেলে বলেন, মেয়ে বলেন, স্ত্রী বলেন, কেউ আপনার নয়। তিনি বলেন, এমনকি তার বাবাও তাকে সম্পত্তি ঠিকমতো বুঝিয়ে দেননি। তার বন্ধুরা ও যাদের ওপর তিনি আস্থা রেখেছিলেন, তারাও তার সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা করেছে। সবটা মিলিয়ে নিজের ওপর তার এমন বিতৃষ্ণা জন্মেছে যে, তার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করছে না।
আবু মহসিন খানের আত্মহত্যা-পূর্ব বক্তব্য আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। আমাদের ধারণা, যারাই ফেসবুক লাইভে তার বক্তব্য শুনেছেন কিংবা পত্রিকায় তা পড়েছেন, তাদের সবাই তার মৃত্যুতে গভীরভাবে আপ্লুত হয়েছেন। মহসিন খান বলেছেন-একা থাকা যে কী কষ্ট, যারা একা থাকে, তারাই তা বলতে পারবেন।
তার এ কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ আমাদের অনেককেই এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, তারা জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না।
আমাদের পরিবারগুলো ক্রমেই ভেঙে যাচ্ছে, পারিবারিক বন্ধন টুটে যাচ্ছে আর এ প্রক্রিয়ায় অনেককেই বেছে নিতে হচ্ছে একাকী জীবন। আবু মহসিন খান তাদেরই একজন।
তিনি সমাজ-বিচ্ছিন্নতার এক অসহায় শিকার। আমরা বলব, তিনি এক প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র, যার মতো আমাদের অনেকেই সার্বক্ষণিক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। তারা হয়তো আবু মহসিনের মতো আত্মহত্যা করছেন না; কিন্তু তারা জীবন্মৃত অবস্থায় দিন পার করছেন।
আবু মহসিন খান যেসব কারণে আত্মহত্যা করেছেন, সেগুলোর অন্যতম হলো-তিনি নানাভাবে প্রতারিত হয়েছেন। বিভিন্ন মানুষের কাছে তার ৫ কোটির অধিক টাকা থাকলেও সেই টাকা তিনি ফেরত পাননি। বলা বাহুল্য, এটা আমাদের সমাজে প্রতারণার এক সাধারণ চিত্র।
প্রতারণা যারা করে তারা বুঝতে পারে না প্রতারিতের মর্মজ্বালা। আবু মহসিন ফেসবুক লাইভে তার টাকা আত্মসাতের জন্য যাদের দায়ী করেছেন, আমরা চাইব তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আবু মহসিনের আত্মহত্যা আমাদের সমাজের কিছু রূঢ় বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সবাইকে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি একেকটি জীবন কীভাবে নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে আছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা ছাড়া, অন্যের দুঃখ উপলব্ধি করার বোধ ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। তাহলেই সম্ভব হবে এমন অনাকাক্সিক্ষত আত্মহত্যা রোধ করা।