বুধবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২২
প্রথম পাতা » অর্থনীতি | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশে এটিএম কার্ড জালিয়াতি যেভাবে ধরা পড়লেন তুরস্কের নাগরিক
বাংলাদেশে এটিএম কার্ড জালিয়াতি যেভাবে ধরা পড়লেন তুরস্কের নাগরিক
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকাঃ এটিএম কার্ড ক্লোন করে জালিয়াতি চক্রের এক বাংলাদেশি সদস্যসহ তুরস্কের হাকান জারবানকানকে গ্রেফতার করেছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ৫৫ বছর বয়সী হাকান এর আগে অন্তত সাতবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সর্বশেষ গত বছরের ৩ ডিসেম্বর অন অ্যারাইভাল ভিসায় ঢাকায় এসে বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে ক্লোন করা বিদেশি এটিএম কার্ড দিয়ে অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি টের পেয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে জানালে তারা অভিযান চালিয়ে এক সহযোগীসহ হাকানকে গ্রেফতার করেন। তার বাংলাদেশি সহযোগীর নাম মফিউল ইসলাম।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, চলতি মাসের শুরুতে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের কর্মকর্তারা তাদের কাকরাইল, মগবাজারসহ একাধিক এটিএম বুথ থেকে বিদেশি একাধিক এটিএম কার্ড উদ্ধার করেন। সেসব কার্ড দিয়ে টাকা তোলার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান তারা। এ ঘটনায় পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পাশাপাশি বিষয়টি ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকেও জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা।
ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ বুথগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। ওই ফুটেজের সঙ্গে আগের এটিএম জালিয়াতি চক্রের সদস্যদের ছবি মিলিয়ে দেখা হয়।
কাউন্টার টেরোরিজম সূত্র জানায়, তারা চক্রটিকে খুঁজতে গিয়ে ২০১৯ সালে ভারতের আসামের এটিএম জালিয়াতির কিছু তথ্য পান। সে সময় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে ইস্টার্ন ব্যাংকের বুথ জালিয়াতির চেষ্টা করা ব্যক্তিদের একজনের ছবির মিল পান। আসাম পুলিশের খাতায় যার নাম হাকান জানবারকান।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পুলিশের বিশেষ শাখার সহযোগিতায় তুরস্ক থেকে আসা ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করেন। এ সময় তারা ৩১ ডিসেম্বর হাকানের বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য পান।
সূত্র জানায়, ওই তথ্য অনুযায়ী হাকানের অবস্থান শনাক্ত করতে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়। ইমিগ্রেশন ফরমে হাকান যে হোটেলের কথা উল্লেখ করেছিল সেই ঠিকানায় গিয়ে হাকানকে পাওয়া যায়নি। পরে পল্টনের ক্যাপিটাল হোটেলে হাকান উঠেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পারেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ৬ জানুয়ারি হাকান হোটেল ছেড়ে চলে যান।
কাউন্টার টেরোরিজিমের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় তারা জানতে পারেন হাকান গুলশানের একটি বাসায় উঠেছেন। ওই বাসা একজন ভারতীয় নাগরিকের নামে ভাড়া নেওয়া।
হাকান ঢাকায় এসে যার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তার বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করেন গোয়েন্দারা। পরে ১৮ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে বনানী এলাকা থেকে হাকানকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার সহযোগী বনানীর জারি ফ্যাশনের বিপণন কর্মকর্তা মফিউলকেও গ্রেফতার করা হয়।কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, হাকান ও তার সহযোগীকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এসব যাচাই করে তার অন্য সহযোগীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় হাকানের নেটওয়ার্ক
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ—বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্রটি তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হাকান জানিয়েছে, ২০১৯ সালে সে আসামের গুয়াহাটিতে এটিএম জালিয়াতি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। সেসময় তার সঙ্গে ফাতাহ আলদেমির নামে তুরস্কের আরেক ব্যক্তি ও দুজন বাংলাদেশিও গ্রেফতার হয়েছিল। এই চক্রে একাধিক ভারতীয় নাগরিক ছাড়াও বুলগেরিয়া ও মেক্সিকোর নাগরিকের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, হাকানের সঙ্গে সাকিব নামে ভারতীয় এক নাগরিকের যোগাযোগের তথ্য তারা পেয়েছেন। তার বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানান, হাকানের সহযোগী মফিউলের আপন বড় ভাই রফিক ভারতে এটিএম জালিয়াতি করতে গিয়ে বর্তমানে দেশটিতে কারাবন্দি আছে।
জিজ্ঞাসাবাদে হাকান জানিয়েছে, তার কাছ থেকে যে ১৭টি ক্লোন কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে, এগুলো সে তুরস্কের নাগরিক আলেকজান্ডারের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। আলেকজান্ডার এই চক্রের আরেক সদস্য। তারা বুলগেরিয়ান একটি ওয়েবসাইট থেকে ৫০ ডলারের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করতো।
হাকান আরও জানিয়েছে, তারা মূলত অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, তুরস্ক, সৌদি আরব, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ভিয়েতনাম, যুক্তরাজ্য, বলিভিয়া, স্পেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়েসহ প্রায় ৪০টি দেশের নাগরিকদের কার্ড ক্লোন করতো।
যেতে চেয়েছিলেন পাকিস্তান
জিজ্ঞাসাবাদে হাকান জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে আসাম পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পালিয়ে সিকিম হয়ে নেপালে যান। নেপাল থেকে তুরস্কে ফিরে নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে আবারও বিভিন্ন দেশে গিয়ে এটিএম জালিয়াতি করতেন। এবার ঢাকা থেকে তার পাকিস্তান যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য ভিসার চেষ্টাও করছিলেন। তবে তার আগেই কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তাকে গ্রেফতার করে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, আর দুই-একদিন দেরি হলেই হাকানকে পাওয়া যেত না। তার পাকিস্তান যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল।
ইন্টারপোলের সহযোগিতা
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট কর্মকর্তারা বলছেন, হাকানের সহযোগীদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক ছাড়াও ভারতসহ অন্যান্য দেশের যে সদস্যরা রয়েছে তাদের শনাক্ত করতে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হবে।
প্রাথমিকভাবে হাকানকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার সহযোগীদের নামের তালিকা নিয়ে ইন্টারপোলে যাচাই-বাছাই করতে দেওয়া হবে।