শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » পরিবেশ ও জলবায়ু | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » বিদায় ২০২১, কেমন ছিল বাংলাদেশ?
বিদায় ২০২১, কেমন ছিল বাংলাদেশ?
বিবিসি২৪নিউজ, এম ডি জালালঃ করোনা অতিমারির মধ্যে কেটে গেলো আরও একটি বর্ষপঞ্জিকা। বিদায়ী বছরের সূর্য ডুবে গেছে। আগামীকাল উঠবে নতুন সূর্য।
২০২১ সালে ছিল নানান ঘটনাপ্রবাহ। অতিমারির ধকল কাটিয়ে একরকম ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস ছিল বছরজুড়ে। তৈরি পোশাক খাতের রফতানি কমে গেলেও ধীরে ধীরে সামলে ওঠা গেছে। সুখকর খবর ছিল, দেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড এবং মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। একইসঙ্গে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
করোনার প্রকোপ থেকে মানুষকে রক্ষার্থে এ বছর শুরু হয় টিকাদান কর্মসূচি। দেশে টিকার জোগান দিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সরকার। এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শুরু হয়েছে বুস্টার ডোজ প্রদান। তবে করোনায় সংক্রমিত হয়ে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট অনেকে মারা গেছেন।
ইতিবাচক কিছু খবরের মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেলের টেস্ট রান। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথমবারের মতো চলেছে মেট্রোরেল। করোনায় থমকে যাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবারও খুলেছে। এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে, ফলও বেরিয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় খবর, নারী ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারা টেস্ট মর্যাদাও পেয়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপলক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। বেশ জাঁকজমকভাবে পালিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। দুটি আয়োজনে অংশ নিতে পৃথকভাবে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
বছরের আলোচিত-সমালোচিত ঘটনার মধ্যে আছে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব হারানো। ডা. মুরাদ হাসান মন্ত্রিত্ব হারিয়ে কানাডার উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু সেদেশে ঢুকতে না পেরে দুবাই হয়ে আবারও দেশে ফিরে আসেন। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে একাধিক মামলা হলেও তিনি এখনও গ্রেফতার হননি। নিজেদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এবং আরও দুই পৌর মেয়র চেয়ার হারিয়েছেন। মানব পাচার, প্রতারণা এবং অর্থপাচারের অভিযোগে কুয়েতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলের কারাদণ্ড হয়।
রাজনীতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আর বিদেশে চিকিৎসার সুযোগের দাবিতে বছরের শেষ প্রান্তে সরব থেকেছে বিএনপি। নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শুরু হলেও বিএনপি এতে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে। সহিংসতার কারণে আলোচনায় ছিল ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক হতাহতের ঘটনা দেখা গেছে সারা দেশে।
সারাবছরই বিভিন্ন সহিংসতার তীরে বিদ্ধ হয়েছে দেশ। দুর্গাপূজার সময় গুজব রটিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলায় উসকানি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলনের নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন পোড়ানো, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অস্থিরতা বিরাজ করেছে। আগুনে বস্তি পুড়েছে, পুড়েছে কারখানা। ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৫ জন নিহত হন। লঞ্চে আগুনের ঘটনা ছাড়াও লঞ্চডুবিতেও মানুষ মারা গেছে।
বহুল আলোচিত ব্লগার অভিজিৎ, প্রকাশক দীপন এবং বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যা মামলার রায় হয়। ঋণের টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলার রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার মোট ১১ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। তিনি এখন দেশের বাইরে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির কারাদণ্ড এটাই প্রথম। সমালোচিত হয়েছে কক্সবাজারে পর্যটককে ধর্ষণের ঘটনা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলামের মতে, বছরটি ছিল বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। তিনি বলেন, ‘২০২১ ছিল আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। একইসঙ্গে আমরা গত ৫০ বছরে কতটুকু কী করতে পারলাম তার মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার বছর ছিল এটি। সবমিলিয়ে বছরটা বিশেষ ছিল। কারণ করোনার অভিঘাত থেকে বেরিয়ে আসার একটা প্রয়াস ছিল আমাদের।’
অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলামের দৃষ্টিতে, ‘করোনায় দেশের অর্থনীতি সরকারি ও বেসরকারি খাতের পূর্ণ অংশগ্রহণে মোটামুটিভাবে সামলে উঠছে। আমরা অনেকে আশঙ্কা করছিলাম, অর্থনীতির ওপর একটা তীব্র আঘাত আসবে। যদিও সেরকম ভয়ানক পরিস্থিতি হয়নি। অর্থনীতির দিক দিয়ে আমরা তেমন কোনও বিপদে পড়িনি। ২০২১ সাল ছিল অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সময়কাল। ঘুরে দাঁড়ানোর যে সক্ষমতা তা আমরা কিছুটা হলেও দেখাতে পেরেছি।’
হতাশার কথাও শোনালেন ঢাবি’র ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এই অধ্যাপক, ‘করোনায় দুই কোটির কাছাকাছি মানুষ নতুনভাবে দারিদ্রের মধ্যে পড়েছে। তাদের জন্য বিশেষ কোনও সহায়তা দেখা যায়নি। আর উন্নয়নের মেগা প্রকল্পগুলো চলছে, সেগুলোর কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখিনি। উন্নয়নের সঙ্গে শাসনব্যবস্থা জড়িত। বিগত বছরগুলোতে যে চিত্র দেখা গেছে, সেসবের মাত্রা আরও বেড়েছে ২০২১ সালে। যেমন বলা যায়– জবাবদিহিতার জায়গা আরও কমেছে, দুর্নীতি কমেনি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা সংকুচিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার কমেনি, বরং আরও বেড়েছে।’
অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলামের মন্তব্য, ‘অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা আমরা দৃশ্যমান করতে পেরেছি, এর সঙ্গে রাজনীতির সুশাসনের পরিবেশ যদি সৃষ্টি করতে না পারি তাহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অর্জন করা আমাদের জন্য দুরূহ হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো কোনও উন্নতি দেখছি না, বরং অবনতি দেখছি। নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে সংলাপ চলছে তা থেকে ইতিবাচক কিছু বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থেকে আমাদের উপলব্ধি আসেনি যে, আন্তর্জাতিক আইন মানতে হবে। আমরা এগুলো বিবেচনায় না নিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন করার দিকে মনোযোগ না দিয়ে আমরা উল্টো তাদের সমালোচনা করছি। এটা আমাদের জন্য হওয়া উচিত ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। ইউপি নির্বাচনের সহিংসতা এবং রাজনীতিতে জনকল্যাণের অভাব আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে না। আমাদের একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার, আমার মনে হয় না সেদিকে আমাদের কোনও নজর আছে।’