শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » পরিবেশ ও জলবায়ু | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশে জলবায়ুর টাকা যাচ্ছে কোথায়!
বাংলাদেশে জলবায়ুর টাকা যাচ্ছে কোথায়!
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকাঃ জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) গ্রহণ করেছে সরকার। এতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতি গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি।
জলবায়ু প্রকল্পের টাকায় উপকূলীয় বনবিভাগে লাগানো হয়েছে আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস। এগুলো মাটির গুণ নষ্টের পাশাপাশি দেশীয় গাছেরও ক্ষতি করে। বিপুল পরিমাণ পানি শোষণ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নামিয়ে দেয়। আশপাশে ফসলও ভালো হয় না। যে কারণে এ জাতীয় গাছ রোপণে আপত্তি জানিয়ে আসছে পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পরিবেশের উপকারে বরাদ্দ করা অর্থ পরিবেশ ধ্বংসের কাজে লাগানো হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় গঠিত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেসিলিয়েন্স ফান্ডের (বিসিসিআরএফ) অর্থায়নে ২৭৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। প্রকল্পে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহবিভিন্ন স্থানে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতির গাছ দিয়ে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ‘স্ট্যান্ডার্ড বায়ো-ফিজিক্যাল’ সার্ভে না করেই উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন বনবিভাগের বাগানে শতকোটি টাকার গাছ লাগানো হয়েছে। যার ৪০ শতাংশ গাছই ‘নিষিদ্ধ’ প্রজাতিভুক্ত ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি বলে সরকারের অডিট অধিদফতরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, গাছগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার আবহাওয়া ও পরিবেশ উপযোগী কিনা সে বিষয় বিবেচনা নেয়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। রোপণের পর পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবও ছিল। এতে সব গাছ মারা যায়। পাশাপাশি ভাঙন কবলিত এলাকায় বনায়ন করায় সেটা নদীগর্ভে বিলিনও হয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নির্বাচিত সাইটের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্ল্যান্টেশন টাইপ নির্ধারণ করতে হয়। কিন্ত এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। নতুন জেগে ওঠা চরে কেবল তখনই বনায়ন করা যাবে যখন বিবেচ্য স্থান বা সাইটটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে—বিবেচ্য স্থানের উপরিতলে কাদা বা মাটির স্তর থাকতে হবে। এই স্তরের পুরুত্ব কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি বা তার চেয়ে বেশি হতে হবে।
বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে পটুয়াখালী ও নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের আওতায় কিছু ম্যানগ্রোভ বনায়ন হয়েছিল। কিন্তু সেখানে মাটির স্তর পুরু ছিল না। চারা ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছে। ম্যানগ্রোভ বনায়নেরও বিশাল এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়েছে।
পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের আওতায় চর গঙ্গামতির বালুকাময় সমুদ্র তীরবর্তী পাঁচ হেক্টর চরের সম্পূর্ণ অংশ স্বল্পমেয়াদি আকাশমনি দিয়ে ‘নন-ম্যানগ্রোভ বাফার জোন’ তৈরি হয়েছে। বায়ো-ফিজিক্যালফিচার অনুসারে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত স্থানটিতে স্থায়ীভাবে ‘ঝঞ্ঝা প্রতিরোধক’ ঝাউ বনায়ন করা উচিত ছিল বলে সরকারের ওই সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গেছে। তবে চট্টগ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগের মনিটরিং প্রতিবেদনে ইউক্যালিপটাসের কথা উল্লেখই করা হয়নি বলেও অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ম্যানুয়ালে (পিআইএম) বলা হয়েছে—সেগুন, গর্জন, মেহগনি, আমলকি, হরিতকি, বহেরাসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রজাতি দ্বারা ‘কোরজোন’ সৃজন করতে হবে। ম্যানগ্রোভ বনায়নে কেওড়া, গেওয়া ও বায়েন প্রজাতির চারা রোপণ করতে হবে। বনায়নে আকাশমনির সংখ্যা ১০ শতাংশের কম থাকবে।
কিন্তু অডিটে দেখা গেছে, বনায়নে আকাশমনি বেশি। অধিকাংশ বাফার জোন, নন-ম্যানগ্রোভ বাফার জোন এবং মাউন্ট বনায়নে ৯০ শতাংশের বেশি আকাশমনি দেখা গেছে। স্ট্রিপ বনায়নেও ৪০ শতাংশের বেশি আকাশমনি রোপণ হয়েছে।
চট্টগ্রাম বনবিভাগের মনিটরিং প্রতিবেদন অনুসারে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বনবিভাগের সন্দীপ রেঞ্জের আওতায় গুপ্তছড়ায় ২০১৪-২০১৫ সালে সৃজিত ম্যানগ্রোভ বনায়ন হয় ১৮৫ হেক্টর। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে সাইটের প্রকৃত আয়তন ১০০ হেক্টর।
প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে কিছু আপত্তি ওঠায় প্রাথমিকভাবে বিষয়টি নিয়ে অডিট করে করে সরকারের অডিট অধিদফতর। অডিট দলকে প্রথমে কোনও জবাব দিতে না পারলেও পরে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, স্থানীয় বনবিভাগের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে চর গঙ্গামতিতে আকাশমনি চারা রোপণ করা হয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে ‘নিউ চর জোনাকে’ নন-ম্যানগ্রোভ বাফার বনায়নও নিঝুম দ্বীপের নন-ম্যানগ্রোভ বাফার ও ১০ হেক্টর মাউন্ড বনায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অডিট রিপোর্টের মন্তব্যে বলা হয়েছে ‘স্ট্যান্ডার্ড বায়োফিজিক্যাল ফিচার’ বিবেচনায় না নেওয়ায় অনেক স্থানে সৃজিত বন দ্রুত বিলুপ্ত হয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পের ডিপিপি এবং পিআইএম’র বিধান লঙ্ঘন করে ঝাউয়ের পরিবর্তে আকাশমনি এবং কোরজোন ও বাফার জোনে ইউক্যালিপটাস লাগানো হয়েছে। যা জলবায়ু সহিষ্ণু টেকসই বনায়ন প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত করেছে।
বনবিভাগের যুক্তি
প্রকল্প পরিচালক অজিত কুমার রুদ্র বলেন, ডিএফও’র (জেলা বন কর্মকর্তা) উত্তর অনুযায়ী, পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের অধীন মহিপুর রেঞ্জের চরগঙ্গামতিতে নন-ম্যানগ্রোভ বাফার জোন প্ল্যান্টেশনে আকাশমনি রোপণ করা হয়। জায়গাটি সম্পূর্ণ বালুকাময় ছিল না। বালি ও কাদামাটি মিশ্রিত ছিল। তাই আকাশমনি বেছে নেওয়া হয়।
বন অধিদফতরের পরিকল্পনা উইং-এর উপপ্রধান বনসংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্ট্যান্ডার্ড বায়োফিজিক্যাল ফিচার অনুসরণ করে বনায়নের জন্য সাইট নির্বাচন করতে হবে কেন? আমরা তো সেখানে সেগুন বা কাঁঠাল গাছ লাগাই না। আকাশমনি লাগানোর বিধান ছিল। তবে কোনও প্রকল্পে ইউকালিপটাস চারা লাগাইনি।বিশেষজ্ঞরা বলছেন
এ প্রসঙ্গে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে। এগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানো যেত। এতে পরিবেশ উপকৃত হতো।
পরিবেশ বিধ্বংসী গাছ লাগানো প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনগণের অর্থায়নে বাস্তবায়িত এই ধরনের বিশেষ প্রকল্পে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এ কাজ করেছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডও এ কাজ করে। এ নিয়ে অনিক প্রতিবাদ করেছি। মন্ত্রী পরিষদ বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেও বলেছি। কোনও সুরাহা নেই। এখন সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে যেসব গাছ লাগাচ্ছি সেখানে এসব লাগানো হবে না।