শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » জেলার খবর | পরিবেশ ও জলবায়ু | প্রিয়দেশ | লাইফস্টাইল | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশে খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বৃষ্টির পানি জমিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে
বাংলাদেশে খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বৃষ্টির পানি জমিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশে খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নের পজাটিলা পাড়ার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দাদের পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েল দিয়েও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। পানির জন্য একমাত্র ভরসা ছিল ছড়ার পাশে তৈরি করা কুয়া, সেটিও জনবসতি থেকে অনেক নিচে। আবার সেই কুয়ার পানিতেও রয়েছে নানা সমস্যা। তাই এখানকার মানুষ এখন আশা দেখছে, বিকল্প প্রক্রিয়ায় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)-এর কারিগরি সহায়তায় স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ‘আলো’র উদ্যোগে সেখানে বসানো হয়েছে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের রিজারভার। এই প্রকল্পের আওতায় সেখানে ‘রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং’ সোর্স স্থাপন করা হয়েছে।
বৃষ্টির পানি ধরে রাখার এই রিজারভারের ধারণ ক্ষমতা ৬ হাজার লিটার। রিজারভারে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি ঘর। সেই ঘরের টিনের চালে পড়া বৃষ্টির পানি দুই পাশ দিয়ে পাইপের মাধ্যমে ছেঁকে এসে রিজারভারে প্রবেশ করে। নির্মিত ঘরের ভেতরের জায়গাকে রাইস ব্যাংক (গোলাঘর) হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে। এই রাইস ব্যাংক প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের জমা করা চাল দুর্যোগের সময় (যেমন খাদ্য সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ) নিজেদের তৈরি নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবহার করেন তারা। একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকল্পের আওতায় দিঘিনালা উপজেলায় আরেকটি সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পজাটিলা পাড়ায় ৩০-৩৫টি পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাদের পানির সংকট দীর্ঘদিনের। এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষিকাজে জড়িত। পানির জন্য তাদের একমাত্র ভরসা টিলা থেকে নিচে অবস্থিত একটি ছড়া। ছড়াটি প্রায়ই ঘোলা পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। বর্ষা মৌসুমে ছড়ায় পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে থাকে না বললেই চলে। সাধারণত সেই ছড়ার পাশে গর্ত করে তারা ছোট ছোট কুয়া তৈরি করেন। সেই কুয়ায় পানি জমা হতে বেশ সময় নেয়। তাছাড়া প্রতিদিন জমা হওয়া পানি ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে পানি ভরার কাজ করতে হয়। জমাকৃত পানিতে প্রায়ই পোকামাকড় পড়ে মরে থাকে। এজন্য প্রতিদিনই তাদের পানি পরিষ্কারের কাজ করতে হয় বলে জানান এলাকাবাসী। এ কাজে এতে অনেক সময় লাগে, আর তখন কুয়ার ধারে কলস নিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় এই পরিবারগুলোকে।স্থানীয় বাসিন্দা দয়ারঞ্জন চাকমা জানান, আমরা ছড়া থেকে পানি এনে রান্না করি, গাছে পানি দেই এবং প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন কাজ সারতে হয়। সবাই এখানে কৃষির ওপর নির্ভরশীল বলে অনেক বেশি পানির প্রয়োজন হয়। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পাড়ার টিউবওয়েলগুলোতেও ঠিকমতো পানি ওঠে না। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হয়।
তিনি বলেন, ছড়ার পানিই আমাদের মূল উৎস। পুরো পাড়ায় একটি কুয়া হওয়ার কারণে যেদিন কুয়া পরিষ্কার করতে হয়, সেদিন পানি আনতে সময় লাগে আরও অনেক বেশি। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে এই কুয়ায় পানি ভরতে বেশি সময় লাগে। বৃষ্টির পানিতে যদি রিজারভারের পুরোটা ভর্তি হয়, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হবে।’
দয়ারঞ্জন চাকমা আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে পাশেই বৌদ্ধবিহার। সেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান হলে পানির খুব সমস্যায় পড়তে হয়। এখন আমরা জমানো বৃষ্টির এই পানি ব্যবহার করে সামাজিক অনুষ্ঠানও সম্পন্ন করতে পারবো।’
.
বৃষ্টির পানি ধরে রাখায় কী ধরনের লাভ হয়, জানতে চাইলে এই পাড়ার আরেক বাসিন্দা বলেন, এই পানি আমরা চারা গাছে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারবো। বিহারে কোনও অনুষ্ঠান হলে সেখানে ব্যবহার করা যাবে। শুষ্ক মৌসুমে আমাদের পানির খুব কষ্ট হতো। পানি আনতে গেলেও অনেক সময় নষ্ট হয়।’ এখন আর সময় নষ্ট হবে না বলে জানান তিনি।
বেসরকারি সংস্থা ‘আলো’র নির্বাহী পরিচালক অরুণ কান্তি চাকমা বলেন, ‘এখানে পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে বন উজাড়, পাথুরে মাটি ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় যথাযথভাবে টিউবওয়েল স্থাপনেরও সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এখানকার অধিবাসীদের পানির উৎস ঘর থেকে অনেক দূরে হওয়ার শুধু পানি সংগ্রহের কাজে তাদের শ্রম এবং সময় অনেক ব্যয় হয়।’ সমাজে ও পরিবারে এ কাজে নারীরা বেশি ভুক্তভোগী বলে জানান তিনি।
অরুণ কান্তি জানান, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কারণে পুরো এলাকাবাসীর যে সুবিধা হবে এমনটাও নয়। তবে এটি একটা নমুনা মাত্র, যা আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। যাতে মানুষ এটা দেখে নিজেদের উদ্যোগে ছোট আকারে হলেও ঘরে ঘরে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতে পারে। তিনি বলেন, ‘মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের পুরোটাই এখানে খরা মৌসুম। এই ৬ হাজার লিটার পানি যদি ধরে রাখে, তাহলে তারা গৃহস্থালিসহ পাড়া ও সমাজের ন্যূনতম উন্নয়নমূলক কাজগুলো তারা করতে পারবে।’
এ প্রসঙ্গে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর এভিলিনা চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় পানির সংকট নিরসনে পরিবেশবান্ধব কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করতে চাইলে সার্ফেস ওয়াটার ব্যবহার গুরুত্বর্পূণ। আমরা বান্দরবানে যেটা করেছি, তা হচ্ছে ঝরনা থেকে পাইপ দিয়ে পাড়া পর্যন্ত পানি নিয়ে এসেছি। সেখানেও রক্ষণাবেক্ষণের একটা বিষয় আছে। পাড়া থেকে সেই জঙ্গলে ঝরনার কাছে রক্ষণাবেক্ষণ করা কষ্টসাধ্য। তাছাড়া এই একটা সোর্স দিয়ে তো হবে না, সেক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি হচ্ছে আরেকটি বিকল্প সোর্স।’তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে আমরা বৃষ্টির পানি নিয়ে প্রথম কাজ করলাম। আমরা খুব অল্প সময় বৃষ্টি পেয়েছি। কারণ, রিজারভার স্থাপনের সময়টা ছিল বর্ষা মৌসুমের শেষ পর্যায়। আমরা বলেছি যে, সেই পানি তারা ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে পান করতে পারবে। পুরো পানির সমস্যা হয়তো এই সিস্টেমে সমাধান হবে না। তবে বর্ষাকাল ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে কমপক্ষে ৩-৪ মাস পানি ব্যবহার করা যাবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখি।’
এভিলিনা চাকমা বলেন, ‘এখানে জনগণের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ে পানি সমস্যার সমাধানে সরকারের ভূমিকা ও উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ সরকারের (এফসিডিও) অর্থায়নে এক্সক্লুডেড পিপলস রাইটস (ইপিআর) প্রকল্পের আওতায় এমজেএফ সমতল ও পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য ১৯ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে।