সোমবার, ৯ আগস্ট ২০২১
প্রথম পাতা » পরিবেশ ও জলবায়ু | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চায়- জাতিসংঘ
বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চায়- জাতিসংঘ
বিবিসি২৪নিউজ, কুটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকাঃ ইনভলান্টারিস অ্যাপিয়ারেন্স সম্প্রতি বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জন ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছে। সেই চিঠির সূত্র ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৪ জুন পুলিশের বিশেষ শাখা এসবিতে একটি চিঠি পাঠায়। ৩৪ জনের একটি তালিকা সংযুক্ত করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চাওয়াসহ চারটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছে এতে। চিঠি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর পাঠানোর পর তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করছেন মাঠ পর্যায়ে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে পুলিশের বিশেষ শাখা-এসবি (এসসিও-সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স) হয়ে ওই চিঠি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ থেকে ৩৪ জনের বিষয়ে একটি চিঠি এসেছে। এগুলো আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়েছি। তারা যে প্রতিবেদন দেবে, আমরা তা-ই জাতিসংঘে পাঠিয়ে দেবো।’
এদিকে গুম হওয়া ৩৪ ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের চিঠি পাঠানোটা একটা বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা। যদিও তারা মনে করছেন, গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে বা অবস্থান জানতে জাতিসংঘের চিঠি পাঠানোর প্রয়োজন ছিল না। গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। কিন্তু গুমের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ এর আগেও গুম হওয়া একাধিক ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের পাঠানো সেসব চিঠির কোনও উত্তর দেয়নি। এছাড়া বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় একাধিকবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। এমনকি মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় কাজ করতে দেশে আসতে চাইলেও বাংলাদেশ সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়া বা গুমের ঘটনাগুলো সব সময় অস্বীকার করে আসছে সরকার।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এবার যেহেতু জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ একটি বড় তালিকা পাঠিয়েছে এবং সেটি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে, এবার অন্তত প্রকৃত সত্যটা উঠে আসা উচিত। কিন্তু চিঠির প্রত্যুত্তর যেন শুধুই ‘আইওয়াশ’ না হয় সেটি লক্ষ রাখতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘বাংলাদেশে গত বেশ কয়েক দশক ধরে একের পর এক গুমের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এটি বন্ধ করার জন্য দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করিনি। গত এক দশক ধরে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কখনোই বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। জাতিসংঘের এই চিঠি অবশ্যই একটা অগ্রগতি। যখন সরকার বা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই বিষয়গুলো উঠবে এটিই স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার কর্মীরা বহুদিন ধরেই একটি স্বাধীন ও আস্থাভাজন তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনও কমিশন এখনও গঠন করতে পারেনি। এখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল যেহেতু সুনির্দিষ্ট ৩৪ জনের বিষয়ে চিঠি দিয়েছে, সরকারের উচিত সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জাতিসংঘে উপস্থাপন করা। এটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কোনও সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
ঢাকার পুলিশ কমিশনারের কাছে ৩৪ জনের তালিকা সংবলিত যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, সেখানে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের পিসি/পিআর (আগের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য) উল্লেখসহ সিডিএমএস (ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) যাচাই করে চারটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলরের ওয়ার্কিং গ্রুপের পক্ষ থেকে যেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছে, তা হলো—গুমের অভিযোগগুলো সত্য কিনা? সত্য না হলে প্রকৃত ঘটনা কী? সরকার এসব বিষয়ে প্রতিকারের জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এসব ঘটনায় গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন তদন্ত হয়েছে কিনা? গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার? এবং গুম হওয়া ব্যক্তিবর্গ ও তাদের পরিবারের জন্য কী ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলরের ওয়ার্কিং গ্রুপের পাঠানো গুম হওয়া ৩৪ জনের বিস্তারিত পরিচয় ও তাদের গুম হওয়ার সময়কার বর্ণনা এবং এ সংক্রান্তে থানা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে অভিযোগ দেওয়ার বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা হলো—মোহাম্মদ চৌধুরী আলম, সাজেদুল ইসলাম, মোহাম্মদ আব্দুল কাদের ভূঁইয়া, মো. কাউসার হোসেন, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, আল আমীন, সোহেল রানা, মোহাম্মদ হোসেন চঞ্চল, পারভেজ হোসেন, মো. মাহফুজুর রহমান, জহিরুল ইসলাম, নিজাম উদ্দিন, মীর আহমাদ বিন কাশেম, মাহবুব হাসান সুজন, কাজী ফরহাদ, সম্রাট মোল্লা, তপন দাশ ওরফে তপু, কে এম শামীম আক্তার, খালেদ হাসান সোহেল, আব্দুল্লাহ আজমি, এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন, মো. হাসিনুর রহমান, রাজু ইসলাম, ইসমাইল হোসেন, মো. তারা মিয়া, মোহাম্মদ নূর হোসেন, মোহন মিয়া, ইফতেখার আহমেদ দিনার, মো. ইলিয়াস আলী, আনসার আলী, কেইথিলপাম নবচন্দ্র, সেলিম রেজা পিন্টু ও জাহিদুল করিম।
নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, ওয়ার্কিং গ্রুপের পাঠানো ৩৪ জনের সম্পর্কে যে পৃথক প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তাতে গুমের শিকার বেশিরভাগকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এই ৩৪ জনের মধ্যে একজন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের সাবেক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে গুম হওয়া একজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত গোলাম আজম ও মীর কাশেম আলীর দুই সন্তানের নামও রয়েছে। এদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে।
তালিকায় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীর নাম
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকায় একজনকে বাংলাদেশ এবং ভারতের নাগরিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেইথেকাম নবচন্দ্র ওরফে শিলহেইবা নামে ওই ব্যক্তির বিষয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ মনিপুরের ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট (ইউএনএলএফ)-এর নেতা। তিনি রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ২ নম্বর সড়কের ৫০ নম্বর বাসায় থাকতেন। ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে দুটি গাড়িতে ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স ইনভেস্টিগেটর ও বাংলাদেশ পুলিশের সাদা পোশাকের একটি দল তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায়। তিন দিনের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানালেও তার আর খোঁজ জানা যায়নি। মনিপুরের বিচ্ছিন্নতাবাদী এই নেতাকে তুলে নেওয়ার দিন মনিপুরেও বিক্ষোভ হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনায় ওই বছরেরই ২০ ফেব্রুয়ারি মনিপুর পুলিশের মহাপরিচালকের কাছে একটি অভিযোগ দেওয়া হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘ভারতের একটি মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের কাছে একবার ইউএনএলএফ মনিপুরের এক নেতার নিখোঁজের বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য চেয়েছিল। আমরা তার বিষয়ে খোঁজ-খবর করেছিলাম। পরে জানতে পেরেছি তিনি ভারতের বিহারে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন।’