সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২১
প্রথম পাতা » পরিবেশ ও জলবায়ু | বিশেষ প্রতিবেদন | শিরোনাম » মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান, বাংলাদেশে কি প্রভাব ফেলবে?
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান, বাংলাদেশে কি প্রভাব ফেলবে?
বিবিসি২৪নিউজ, আশরাফ আলী, বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকাঃ মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান কি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো প্রভাব ফেলবে? বাংলাদেশ তেমনটি আশা না করলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে যেতে পারে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশ মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সাথে সাথে বাংলাদেশ আশা করছে এই কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে এ নিয়ে একটি বিবৃতি দেয়া হবে।
মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেত্রী অং সান সু চি, দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে সে দেশের সেনাবাহিনী আটক করে ক্ষমতা দখল করে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। কমান্ডার-ইন-চিফ মিন অং হ্লেইংয়ের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে।
মিয়ানমারে অভ্যুত্থান: বাংলাদেশসহ অন্যদের প্রতিক্রিয়া
‘‘মিয়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমরা অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও ধারাবাহিক প্রত্যাবর্তনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে,’’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সকে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে৷ ‘‘আমরা আশা করি, এই প্রক্রিয়াগুলো সঠিক ও আন্তরিকভাবে চলতে থাকবে,’’ বলেও বিবৃতিতে আশা করা হয়৷
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ‘‘রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মিয়ানমারের সব পক্ষ সাংবিধানিক ও আইন মেনে তাদের মধ্যকার মতপার্থক্যের একটি সমাধান খুঁজবে বলে মিয়ানমারের বন্ধু প্রতিবেশী দেশ চীন আশা করছে৷’’
এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘‘গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমরা মিয়ানমারের খবর দেখেছি৷ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভারত সবসময় সমর্থন দিয়ে এসেছে৷ আমরা বিশ্বাস করি, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে৷
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি ও উন্নয়নের প্রতি বার্মার জনগণের প্রত্যাশার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আছে৷ সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই অবিলম্বে এসব সিদ্ধান্ত পালটাতে হবে৷
হোয়াইট হাউস
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি জানানো হয়েছে৷ হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘‘সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফল পালটে দেয়া বা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টার বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র৷’’ মিয়ানমারে নতুন করে সিদ্ধান্ত না বদলালে এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি৷
জাতিসংঘ
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মিয়ানমারে যা ঘটেছে তা ‘গণতান্ত্রিক সংস্কারের উপর মারাত্মক বাধা’৷ তিনি সব নেতৃবৃন্দকে সহিংসতা থেকে দূরে থাকার ও মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন৷
জার্মানি
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস বলেছেন, ‘‘মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও সেইসঙ্গে আটকের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি আমি৷ সামরিক বাহিনীর এই কার্যক্রম মিয়ানমারে এতদিন যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উন্নতি এসেছে তা ঝুঁকিতে ফেলবে৷’’
ব্রিটেন
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন টুইটারে লিখেছেন, ‘‘আমি মিয়ানমারে অভ্যুত্থান ও অং সান সু চিসহ অন্যদের বেআইনিভাবে আটকের নিন্দা করছি৷’’ তিনি বলেন, ‘‘জনগণের দেয়া ভোটকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে এবং বেসামরিক নেতাদের মুক্তি দিতে হবে৷’’
ইউরোপীয় কাউন্সিল
কাউন্সিলের প্রধান চার্ল মিশেল টুইটারে লিখেছেন, ‘‘আমি মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি৷ যাদের আটক করা হয়েছে তাদের ছেড়ে দিতে সামরিক বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি৷
বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতিতে সবচয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো রোহিঙ্গাদেও ফেরত পাঠানোর ইস্যুটি। ২০১৮ সালে চুক্তি সই হলেও এখনো মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। এখন নতুন এই পরিস্থিতিতে কী হবে?
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক এটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘‘ আমার বিবেচনায় আগামী এক বছরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন পিছিয়ে গেল। কারণ, সামরিক বাহিনীর যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে। তারা সব এক্জিকিউটিভ, লেজিসলেটিভ এবং জুডিশিয়ারি এখন তাদের ক্ষমতায় ন্যাস্ত। আগের সিদ্ধান্ত তো ছিল অং সান সুচির, এখন তো সামরিক বাহিনী এসেছে। এখন তারা সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে এক বছরের আগে কোনো কাজ করবে বলে আমার মনে হয় না। ”
তার কথা, ‘‘মিয়ানমারে সামরিক সরকার যে লক্ষ্য নিয়ে এসেছে তা আগে পুরণ করবে। সেই টার্গেটে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া আছে বলে আমরা মনে হয় না।”
তার মতে, তিনটি কারণকে সামনে রেখে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। মিন অং হ্লেইংয়ের আগামী জুনে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয়ত, গত নির্বাচনে সেনা সামর্থিত দল ইউএসডিপির ভরাডুবি হয়েছে। তিনি বলেছেন নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। আর তৃতীয়ত, বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছে, যা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বড় ধরনের বিপদে ফেলতে পারে। তাই হয়ত ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী তাদের প্রটেকশনে নিয়ে নিলো।
সেনা অভ্যুত্থান ও সুচি
মিয়ানমার বা বার্মা স্বাধীনতা পায় ১৯৪৮ সালে। তারপর তিনবার নির্বাচন হয়েছে সেদেশে। কিন্তু ১৯৬২ সালে সেনা অভ্যুত্থান হয়। সেনা-শাসন চলে ২০১১ সাল পর্যন্ত। আর সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন সুচি। তিনি গৃহবন্দি ছিলেন ১৫ বছর।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই
অং সান সুচির বাবা মিয়ানমারের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। পরে নিহত হন। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে পড়া শেষ করে দেশে ফেরেন সুচি। ১৯৮৮ সালে দেশের সেনা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু সুচির। ১৯৯০ সালে তাঁর দল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল ভোটও পায়। কিন্তু সরকার নির্বাচনকে মান্যতা দেয়নি।
সুচি গৃহবন্দি
১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ১৫ বছর গৃহবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন সুচি। দেখা করতে পারেননি স্বামী এবং দুই পুত্রের সঙ্গে। কিন্তু গৃহবন্দি অবস্থাতেই গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
আবার সেনা অভ্যুত্থান, আবার বন্দি সু চি
নোবেল পুরস্কার
সুচির আন্দোলন গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেয়। ১৯৯১ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। তাঁকে নিয়ে এক ফরাসি পরিচালক ছবি তৈরি করেছেন। আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মান এবং পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আবার সেনা অভ্যুত্থান, আবার বন্দি সু চি
নির্বাচন এবং জননেত্রী
২০১২ সালের নির্বাচনে অংশ নেন সুচি। জয়লাভ করেন। সেনা সরকার ক্রমশ গণতান্ত্রিক কাঠামো স্বীকার করতে শুরু করে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে সুচি মিয়ানমারের রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হন।
রোহিঙ্গা এবং অন্য সুচি
তাল কাটে এক বছরের মধ্যেই। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশের সেনাবাহিনী যখন অত্যাচার চালাতে শুরু করে, সুচি তাতে বাধা দেননি। রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। কিন্তু সুচি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
আন্তর্জাতিক চাপ
রোহিঙ্গা ইস্যুতে গোটা বিশ্ব সুচির উপর চাপ দিতে শুরু করে। বেশ কিছু পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়া হয়। নোবেল কমিটিও নোটিস জারি করে। কিন্তু সুচি নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে সুচি।
কারচুপির নির্বাচন
গত বছর নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে সুচির দল ফের ক্ষমতায় আসে। কিন্তু তাঁর দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে।
সেনার সঙ্গে দূরত্ব
সেনার সঙ্গে সুচির দূরত্ব ক্রমশই বাড়ছিল। দেশে যে সেনা ফের অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে, সেই সন্দেহও প্রকাশ করছিলেন কেউ কেউ।
সুচি আটক
রোববার রাতে আচমকাই সেনা সুচিকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার করা হয়েছে দেশের একাধিক মন্ত্রী এবং বিভিন্ন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের। সেনা তাদের অজানা জায়গায় নিয়ে গেছে।
সেনাশাসনের ঘোষণা
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান মিং অং হ্লেইং সেনা টেলিভিশনে ঘোষণা করেছেন, নির্বাচনে কারচুপির জন্য সুচিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আপাতত আগামী এক বছরের জন্য দেশের দায়িত্ব নেবে সেনাবাহিনী।
দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা
রোববার থেকে গোটা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সেনা। সরকারি টেলিভিশনও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। সুচির গ্রেফতারির খবর প্রথম জানিয়েছিলেন সরকারের মুখপাত্র। তাঁর সঙ্গেও আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, মিয়ানমারে সামরিক শাসনের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ, এটা কোনো ব্যক্তির সাথে চুক্তি নয়, এটা রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের চুক্তি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারাই থাকুকনা কেন তারা চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য।
তিনি বলেন ,‘‘ মিয়ানমার তো অধিকাংশ সময় ধরে সামরিক শাসনেই আছে। অতীতে মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়েছে। বরং অং সান সুচির সময়ই কোনো রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, “৭০ এবং ৯০-এর দশকে বড় আকারের যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হয়েছে তখন কিন্তু সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় ছিল। বরং এবার গণতন্ত্রের কথা বলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, ভারত এরা কেউ কিন্তু চাপ প্রয়োগ করেনি। তারা বলেছে, গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
মিয়ানমারের ব্যাপারে ইউরোপ, অ্যামেরিকার পলিসি ভুল প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই অধ্যাপক। তার মতে এখন তাদের সেখানে প্রচলিত ধারায় গণতন্ত্র উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় কাজ হবে না। বাণিজ্যিকসহ আরো নানা ধরনের অবরোধ দিতে হবে।
তার মতে, ‘‘বাইডেন প্রশাসন বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন যদি মিয়ানমারের ওপর চাপ দেয়, তাতেও লাভ আছে। তারা হয়ত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইবে। আর বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশ্ন আসবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে । বাংলাদেশ তো সেখানেই জোর দেবে। সেখানে কে ক্ষমতায় থাকলো, বাংলাদেশের জন্য সেটা বড় ইস্যু নয়।