মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » প্রিয়দেশ | বিশেষ প্রতিবেদন | শিরোনাম » বিজয়ের ৪৯ বছরঃ আজ হানাদারমুক্ত হয় কয়েকটি জেলায়
বিজয়ের ৪৯ বছরঃ আজ হানাদারমুক্ত হয় কয়েকটি জেলায়
বিবিসি২৪নিউজ,আরিফুর রহমানঃ ১৯৭১ সালের আজকের ৮ ডিসেম্বর এই দিনে মিত্রবাহিনীর মাধ্যমে তাদের পুরো বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হয় । এদিন হানাদারমুক্ত হয় মৌলভীবাজার, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা (তৎকালীন থানা)। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়কে সামনে রেখে ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির অসীম সাহস আর রণনীতির কাছে পাকিস্তানি সেনারা পরাজিত হতে থাকে বাংলার বিভিন্ন জনপদে। জলে, স্থলে, আকাশে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে যায়। অনেক জায়গায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তারা।
এসব এলাকাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ হামলা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ৫ ডিসেম্বর থেকে পাক হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়তে শুরু করে। পাক সেনারা তখন সিলেটের দিকে পালাতে শুরু করে।
পালানোর সময় তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে অনেক নিরীহ মানুষ শহীদ হন। সিলেটে যাওয়ার পথে পাকবাহিনী শেরপুরে অবস্থান নিলে সেখান থেকেও তাদের বিতাড়িত করা হয়। এতে ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার পুরোপুরি হানাদারমুক্ত হয় এবং আকাশে ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বাঞ্চল আখাউড়া মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। আখাউড়া থেকে রেললাইন ও উজানী শহর অতিক্রম করে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই যৌথবাহিনী পৌঁছে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। ৮ ডিসেম্বর সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
এদিন পাকবাহিনীর কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিল চাঁদপুর জেলা। ইতিহাস বলে, তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা জেলায় সর্বশেষ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর লাকসাম ও মুদাফ্ফরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর। যৌথবাহিনী হাজীগঞ্জ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর চাঁদপুরে প্রবেশ করতে থাকলে মুক্তিসেনারা হানাদার বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
এ সময় ভারতের মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যৌথ আক্রমণ চালায়। দিশা না পেয়ে পাকিস্তান ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল রহিম খান চাঁদপুর থেকে পলায়ন করেন। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা তীব্র লড়াইয়ের পর ৮ ডিসেম্বর জেলার হাজীগঞ্জ এবং বিনা প্রতিরোধেই চাঁদপুর হানাদারমুক্ত হয়।
এদিন কুমিল্লা পাক হানাদার বাহিনীর রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ আর নির্যাতনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীসহ সর্বস্তরের জনগণের উল্লাস ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে কমিল্লা। মুক্ত হয় কুমিল্লা।
৭ ডিসেম্বর রাতে তিনদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাকবাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে। ওই অবস্থানের ওপর মুক্তিসেনারা মর্টার আর্টিলারি আক্রমণ চালিয়ে শেষ রাতের দিকে তাদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়। সারারাত পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষদিকে ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় বরিশাল অঞ্চল। এদিন বরিশালকে পাক হানাদারমুক্ত করে বিজয়ের পতাকা ওড়ান অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা।
এদিকে মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণ করলে পাকবাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে।
জেনারেল মানেকশ’র এই আহ্বান আকাশবাণী (বেতার) থেকে নানা ভাষায় বারবার প্রচার করা হয়। পাকিস্তানের শাসকরা নিজেদের অবস্থা পুরোপুরি বুঝতে না পেরে আত্মসমর্পণের দিকে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাংলাদেশে অবস্থানরত সেনাদের নির্দেশ দেন। কিন্তু পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল রণাঙ্গনে থাকা পাক কমান্ডাররা। কারণ বিভিন্ন স্থান থেকে পাকবাহিনীর পরাজিত হওয়ার খবর আসছিল।
পাকিস্তান ও তার মিত্র দেশগুলোর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যুদ্ধে তাদের হার নিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি পালন এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে।
উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।
এদিকে এ অবস্থার মধ্যেও কিসিঞ্জার পাকিস্তানের জন্য ‘সামরিক সরবরাহ’ নিশ্চিত করার পক্ষে তার অভিমত প্রকাশ করেন। যা ছিল কেবলই হাসির নামান্তর।