বুধবার, ২৯ জুলাই ২০২০
প্রথম পাতা » প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশ এবার কোরবানির পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ
বাংলাদেশ এবার কোরবানির পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ
বিবিসি২৪নিউজ,বিশেষ প্রতিবেদক,ঢাকা : বাংলাদেশে এবার কোরবানির জন্য প্রয়োজনের বেশি পশু দেশেই উৎপাদন করেছেন খামারিরা। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দেশে কোরবানির জন্য গবাদিপশুর পর্যাপ্ত জোগান রয়েছে, তাই কোরবানির জন্য কোনোভাবেই বিদেশ থেকে গবাদিপশু আনার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কোনোভাবেই যাতে দেশের কোনও সীমান্ত দিয়ে অবৈধ বা চোরাইপথে কোনও পশু, বিশেষ করে গরু আসতে না পারে সেজন্য প্রাণিসম্পদের চিঠিতে গত ১৩ জুলাই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা ও সুরক্ষা বিভাগ। মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ঈদুল আজহায় ৪২ লাখ গরুসহ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি করা হয়েছিল। তার আগের বছর ২০১৮ সালের ঈদুল আজহায় ৩৮ লাখ গরুসহ প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর এই সংখ্যা ৫ হাজার করে বাড়লেও করোনার কারণে এ বছরের চিত্র ভিন্ন। সেই হিসাবে এ বছর কোরবানিতে ১ কোটি ১৩ থেকে ১৫ লাখ পশুর চাহিদার বিপরীতে ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি গবাদিপশু কোরবানির জন্য মজুত রয়েছে। এরমধ্যে হৃষ্টপুষ্ট গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ও অন্যান্য পশু রয়েছে ৪ হাজার ৫০০টি। এবারের ঈদুল আজহায় চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪ লাখ পশু বেশি প্রস্তুত রয়েছে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বানের পানির সঙ্গে গরু ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেসব গরু ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করছে। এসব গরু আনার সময় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে কেউ কেউ নিহত হচ্ছেন। কোরবানি উপলক্ষে এসব অপতৎপরতা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে অপতৎপরতা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন ঈদুল আজহার কোরবানিকে সামনে রেখে সীমান্ত পথে গবাদিপশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রাণিস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্টেরয়েড ও হরমোন জাতীয় ওষুধ চোরাইপথে আসা বন্ধকরণের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এর অংশ হিসেবে গত ৯ জুলাই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘কোরবানির পশুর হাটে সুস্থ-সবল গবাদিপশু সরবরাহ ও বিক্রয় নিশ্চিতকরণ’ সংক্রান্ত এক আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ১৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জননিরাপত্তা বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে গবাদিপশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং জালটাকা রোধসহ গবাদিপশুর কৃত্রিম সংকট তৈরি বন্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা প্রদানের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো অপর এক চিঠিতে সীমান্তবর্তী এলাকায় দেশের বাইরে থেকে গবাদিপশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবি ও বাংলাদেশ পুলিশকে যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে অনুরোধ জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো আরেকটি চিঠিতে সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রাণিস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্টেরয়েড ও হরমোন জাতীয় ওষুধ চোরাইপথে আসা বন্ধকরণে বিজিবি ও বাংলাদেশ পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই চিঠিতে কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ, হাটের বাইরে এবং অনলাইনে গবাদিপশু কেনাবেচার ক্ষেত্রে ইজারা সংক্রান্ত হয়রানি বন্ধ, চাঁদাবাজি বন্ধ করে গবাদিপশুর নির্বিঘ্ন পরিবহন নিশ্চিতকরণ, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপতৎপরতা রোধ, রোগাক্রান্ত গবাদিপশুর চলাচল বন্ধে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর স্থাপিত চেকপোস্টে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় বিজিবি ও বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এদিকে দেশি খামারে পালিত কোরবানির পশু বিক্রিতে যাতে ব্যবসায়ী বা খামারিরা কোনও হয়রানিতে না পড়েন, সেজন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
গত ৯ জুলাই বৃহস্পতিবার সচিবালয়স্থ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কোরবানির পশুর হাটে সুস্থ-সবল গবাদিপশু সরবরাহ ও বিক্রয় নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত এক অনলাইন সভায় সভাপতির বক্তব্যে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিবছর কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা হয়। কোরবানির পশু পরিবহনে রাস্তায় চাঁদাবাজি হয়, দীর্ঘসময় প্রাণীকে ট্রাকে আটকে রাখতে হয়। এবার আমরা চাই কোনরকম চাঁদাবাজি হবে না। যে অঞ্চলে সুযোগ আছে সেখান থেকে ট্রেনে পরিবহন হবে। খামারিদের খামারে পশু বিক্রি হলে সেখান থেকে ইজারাদার টোল আদায় করতে পারবেন না।’
এদিকে কোরবানির পশুর হাটে ভেটেরিনারি মেডিক্যাল সেবা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন হাটের জন্য ১৮টি ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম ও ১টি বিশেষজ্ঞ ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম গঠন করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য ৪টি কোরবানির হাট ব্যবস্থাপনা মনিটরিং টিম ও ১টি কন্ট্রোল রুম ব্যবস্থাপনা টিম গঠন করেছে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর।
এছাড়াও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উদ্যোগে সারা দেশের কোরবানির পশুর হাটের জন্য ১ হাজার ২১৩টি ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব কার্যক্রম তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিমও গঠন করা হয়েছে।
এদিকে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুর রহমান জানিয়েছেন, কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের স্রোতে ভেসে প্রতিদিন ভারতীয় গরু ঢুকছে বাংলাদেশে। এতে আসন্ন ঈদে দেশীয় গরুর খামারি ও গৃহস্থরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার সীমান্তপথে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রতি রাতে শত শত গরু ও মহিষ দেশের সীমানায় প্রবেশ করানো হচ্ছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দইখাওয়া, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়ন এবং নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সীমান্তের নদীপথে প্রচুর ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এসব গরু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলার হাটগুলোতে বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে। সেখান থেকে ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। তবে বিজিবি বলছে, সীমান্তে নজরদারিসহ টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া ও নদ-নদীতে পানি বাড়ার কারণে চোরাকারবারিরা বিভিন্নভাবে সীমান্তের নদীপথে গরু প্রবেশ করাচ্ছে। গরুর লট প্রবেশের খবর পাওয়া মাত্র তা সিজ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিবি-২২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ জামাল কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিকে জানান, বন্যা এবং বৈরী আবহাওয়ায় সীমান্তে নজরদারি বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে চোরাকারবারিরা। বিজিবিও নৌপথে টহল জোরদার করেছে। এরপরও যদি কোনও ভারতীয় গরু পাচারের খবর পাওয়া যায় তাহলে বিজিবি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম বলেন, ‘দেশীয় খামারি ও গরু ব্যবসায়ীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সীমান্তপথে ভারতীয় গরুপাচার রোধে প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নিয়েছি। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের (ইউএনও) এই বিষয়ে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় গরুপাচার রোধে আমাদের টাস্কফোর্স কাজ করছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।