আকাশপথে কাঙ্কিত যাত্রী নেই
বিবিসি২৪নিউজ,বিশেষ প্রতিনিধি : করোনা মহামারির কারনে প্রায় আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর গত ১ জুন থেকে অভ্যন্তরীণ রুট ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর এবং পরবর্তীতে যশোর রুটে ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয় বেবিচক। তবে শর্ত দেয়া হয়, ফ্লাইটে যাত্রী থাকবে মোট সিটের ৭৫ শতাংশ।স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটি উড়োজাহাজ তার ধারণক্ষমতার ৭৫ শতাংশ যাত্রী নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে। করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় এমন শর্ত দিলেও আকাশপথে কাঙ্ক্ষিত যাত্রীর দেখা মিলছে না। অভ্যন্তরীণ রুটে প্রতিদিনই অর্ধেক কিংবা অর্ধেকের কমসংখ্যক যাত্রী নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলোকে। আবার কোনো কোনো ফ্লাইটে মিলছে হাতেগোনা কয়েকজন যাত্রী।
এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, অভ্যন্তরীণ রুটে ছোট আকারের এটিআর বা ড্যাশ বিমান দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। বিমানগুলো ৭২ থেকে ৮০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। যদি কোনো এয়ারলাইন্সের ৮০ যাত্রী বহনের ধারণক্ষমতা থাকে তাহলে তারা এখন ৬০ জন যাত্রী নিতে পারবে। বাকি সিটগুলো ফাঁকা থাকবে। তবে এয়ারলাইন্সগুলো বর্তমানে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স জানায়, অভ্যন্তরীণ চারটি রুটে প্রতিদিন ৩২টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে তারা। ফ্লাইট চালুর পর থেকে তাদের গড় যাত্রীর সংখ্যা থাকছে প্রায় ৬০ ভাগ। নভোএয়ারের অবস্থাও একই। ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ যাত্রী নিয়ে তারা ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
যাত্রী সংকটের কারণে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রেখেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বর্তমানে শুধুমাত্র বিশেষ ফ্লাইট (চার্টার) এবং সপ্তাহে একদিন লন্ডন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে তারা। আরেক বেসরকারি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট এয়ারওয়েজ মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তিন মাসের জন্য সবধরনের ফ্লাইট চলাচল স্থগিত রেখেছে।
কেন এই হাল?
নভোএয়ারের মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার এ কে এম মাহফুজুল আলম বলেন, যাত্রীর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। গত কয়েকদিনে গড়ে সর্বোচ্চ ৫৫ ভাগ যাত্রী যাতায়াত করেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ায় অনেকেই আতঙ্কিত। এক্সট্রিম নিড ছাড়া কেউ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাচ্ছেন না। প্রাদুর্ভাব কমলে আস্তে আস্তে যাত্রীর সংখ্যা বাড়বে।
এছাড়া কক্সবাজার, বরিশাল ও রাজশাহীর ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। রুটগুলোতে অনেক যাত্রী যাতায়াত করতেন। এগুলো খুলে দেয়া হলে যাত্রী সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযাগ) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় স্বাস্থ্যবিধিগুলো সুচারুভাবে পালন করে ইউএস-বাংলা ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আমরা ভাড়ার বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে যাত্রীদের সেবার বিষয়টি মাথায় রেখে ফ্লাইট পরিচালনা করছি। তবে একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো যাত্রী এখন এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে যাচ্ছেন না। তাই যাত্রী সংখ্যা তুলনামূলক কম।
যাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধিতে কী প্রয়োজন?
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা এয়ারলাইন্সকে প্রণোদনা ও আকর্ষণীয় অফারের মাধ্যমে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ানোর কথা বললেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেবিচক বলছে, করোনা আতঙ্ক না কাটলে যাত্রীর সংখ্যা বাড়বে না।
এদিকে ফ্লাইট চালুর প্রথমদিকে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো প্রায় সব রুটে সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা ভাড়ায় যাত্রী নেয়া শুরু করে। আলোচনা হচ্ছিল প্লেনের ভাড়া প্রায় আন্তঃনগর বাসের ভাড়ার সমান হওয়া নিয়ে। তবে বেবিচক তাদের ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্তকে ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ উল্লেখ করে ন্যূনতম ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। ভাড়ার পরিমাণ ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে সর্বনিম্ন সাড়ে তিন হাজার টাকা আর বাকি সব অভ্যন্তরীণ রুটে দুই হাজার ৫০০ টাকা।
ভাড়া নির্ধারণ ও বৃদ্ধির কারণে যাত্রী সংখ্যা কমেছে কি-না, জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। এয়ারলাইন্সগুলো প্রতিযোগিতা করে ভাড়া কমিয়ে দিয়েছিল, যা করা মোটেও উচিৎ হয়নি। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যাত্রীরা এখন অতিপ্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ করছেন না। তারা পরিস্থিতি দেখে ভীত, প্লেন ভ্রমণের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। এই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে যাত্রীর সংখ্যা আবারও আগের মতো বেড়ে যাবে।’
এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা দেয়ার বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘এভিয়েশন খাতকে বাঁচাতে আমরা ইতোমধ্যে ল্যান্ডিং চার্জসহ বেশ কয়েকটি চার্জ মওকুফের বিষয়ে একটি প্রণোদনা প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। সেই বিষয়ে এখনও কোনো আপডেট পাওয়া যায়নি।’
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, দেশের এভিয়েশন খাতকে বাঁচাতে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর এভিয়েশন চার্জ (অ্যারোনটিকাল ও নন-অ্যারোনটিকাল উভয়ই) মওকুফের জন্য একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই প্রণোদনা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ২০২১ সাল পর্যন্ত কোনো অ্যারোনটিকাল চার্জ দিতে হবে না। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চার্জ ৫০ শতাংশ মওকুফ করা হয়েছে।
অ্যারোনটিকাল চার্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিমানের ল্যান্ডিং চার্জ, রুট নেভিগেশন সার্ভিস চার্জ, বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহারের চার্জ, এমবারকেশন ইত্যাদি। এছাড়া এয়ারপোর্টে এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানগুলোর নন-অ্যারোনটিকাল চার্জও (গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং, চেক-ইন কাউন্টার ভাড়া, কার পার্কিং, এভিয়েশন ক্যাটারিং সার্ভিস) ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘বর্তমান মহামারিকালে অনেকেই আকাশপথে যাত্রার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া আগের মতো ব্যবসায়িক বা অবসর ভ্রমণ বন্ধ রয়েছে, এ কারণে যাত্রীর সংকট হচ্ছে। আগে অনেকেই পরিবার নিয়ে কক্সবাজারসহ নানা স্থানে ভ্রমণ করতেন। বর্তমানে এটা বন্ধ আছে। এছাড়া জরুরি ব্যবসায়িক মিটিংগুলো জুমসহ অন্যান্য অনলাইনের মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে যাত্রীর সংখ্যা কম হচ্ছে। তারপরও বেসরকারি বিমান সংস্থাসমূহ যে ফ্লাইট পরিচালনা করে যাচ্ছে, এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক রুটে চীন, মধ্যপ্রাচ্যের কাতার-দুবাই (ট্রানজিট) ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে (শুধুমাত্র লন্ডন) উড়োজাহাজ চলাচল চালু রয়েছে। রুটগুলোতে ঢাকা থেকে যাত্রী গেলেও দেশে আসছেন কম।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ঢাকা থেকে চীনের গুয়াঞ্জু রুটের ফ্লাইটে যাত্রী সংখ্যা অনেক কমেছে। প্রতিদিন গড়ে ঢাকা থেকে গুয়াঞ্জু যাচ্ছেন ১০০ জন, ঢাকা ফিরছেন ২০ থেকে ২৫ জন। সপ্তাহে একদিন ফ্লাইট পরিচালনাকারী বিমান বাংলাদেশের প্রথম ফ্লাইটে লন্ডন গেছেন ১৮৭ জন। যাওয়ার সময় ফ্লাইটটি প্রায় ভরা থাকলেও ঢাকায় ফেরার সময় যাত্রী সংখ্যা ছিল মাত্র ২৮ জন। সপ্তাহে তিনদিন করে ফ্লাইট পরিচালনাকারী কাতার এয়ারওয়েজ ও এমিরেটসের ফ্লাইট ঢাকা থেকে ছাড়ার সময় প্রায় ভরা থাকলেও বাংলাদেশে খুব কম লোকই আসছেন।
এদিকে, কার্গো পরিবহন ক্ষমতা বাড়াতে ইকোনমি শ্রেণির কেবিন সরিয়ে কার্গো বিমানে রূপান্তর করছে এমিরেটস। এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজে ইকোনমি শ্রেণির যাত্রী আসনগুলো সরিয়ে কার্গো পরিবহনের উপযোগী করে তুলছে। রোববার (২৮ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় এমিরেটস বাংলাদেশ।
এর আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ২১ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য, চীন, হংকং, থাইল্যান্ড ছাড়া সব দেশের সঙ্গে এবং অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল বেবিচক। এরপর আরেকটি আদেশে চীন বাদে সব দেশের সঙ্গে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা সরকারি সাধারণ ছুটির সাথে সমন্বয় করে পর্যায়ক্রমে ১৪ ও ৩০ এপ্রিল পরবর্তীতে ৭ , ১৬ ও ৩০ মে এবং সর্বশেষ ১৫ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ১৬ জুন থেকে ঢাকা-লন্ডন রুটে, পরবর্তীতে কাতার রুটে এবং ২১ জুন থেকে এমিরেটসকে ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয় বেবিচক।
জুনের শুরুর দিন থেকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর এবং পরবর্তীতে যশোর রুটে ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে মালয়েশিয়ান এয়ার, মালিন্দো এয়ার, এয়ার অ্যারাবিয়া, ফ্লাই দুবাই ও টার্কিশ এয়ারলাইন্স।