শুক্রবার, ২৯ মে ২০২০
প্রথম পাতা » ছুটির দিনে | পরিবেশ ও জলবায়ু | ফিচার | শিক্ষাঙ্গন | সম্পাদকীয় » বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসের পূর্ব প্রস্তুতি- প্রফেসর ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসের পূর্ব প্রস্তুতি- প্রফেসর ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
বাংলাদেশে গত ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল সংকট স্বল্পস্থায়ী হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে লাশ আর লাশ l বিশেষ করে গত কয়েক দিনে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে l বিশেষজ্ঞদের মতে এই প্রাদুর্ভাব খুব শীঘ্রই শেষ হবে না l হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার আসবে l যেমনটি হচ্ছে চীনে l অনেকের ধারণা এটি আগামী দুই বৎসর পর্যন্ত চলমান থাকবে কিংবা সবসময়ের জন্যই থেকে যাবে l অর্থাৎ এটাকে নিয়েই আমাদের আগামী দিনের সকল পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে l এর মানে হচ্ছে, দৈনন্দিন চলাচলে স্বাস্থ্যবিধির সকল নিয়মকানুন মেনে তা অভ্যাসে পরিণত করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে আমাদের l
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জাতির বিবেক ও জ্ঞানের বাতিঘর l আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা মানে জাতির বিবেক ঘুমিয়ে থাকা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হওয়া l এমতাবস্তায় অনিদ্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের জন্য তা সমুহ ক্ষতির কারন হবে। শিক্ষার্থীরা হবে বিপথগামী, সৃষ্টি হবে সমাজে বিশৃংখলা। এমনকি শিক্ষার মানও কমে যেতে পারে অনেক, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় জীবনে। রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে পারে দক্ষ মানবশক্তি তৈরিতে। সমস্যা সমাধান করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি), মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই তৎপর l বিকল্প হিসেবে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া যায় কিনা তার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ইউজিসি ইতোমধ্যেই অনলাইনে একটি সমীক্ষা (Survey) সম্পন্ন করেছে - যেখানে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সম্মানিত শিক্ষকগণ l ধারণা করা হচ্ছে খুব শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয় খোলা বা অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা আসবে l
অনলাইনে ক্লাস শুরু করার পূর্বে অফলাইন বা প্রচলিত ক্লাসরুমের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা দরকার l অনেক ডিপার্টমেন্টেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্লাসরুম নেই - আর যে কটা ক্লাসরুম আছে, সেখানে আসনের তুলনায় ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি l সকল শিক্ষকের বসার রুম আছে কিনা সে কথা নাইবা বললাম l দুজন সিনিয়র শিক্ষক এক রুমে বসে বছরের পর বছর কাজকর্ম করেন - এটা আর এমন কি l তাই অনলাইনে ক্লাস শুরু করার পূর্বে প্রচলিত ক্লাসের অবকাঠামোগত উন্নয়ন আগে দরকার l দরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ এবং আসন সংখ্যার অনুপাতে ছাত্রের সংখ্যা সমান হওয়া l সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস পরিচালনা করতে গেলে একটি ক্লাসকে চারবারে নিতে হবে l কিন্তু বাস্তবে কি সেটা সম্ভব ? ছাত্র-শিক্ষকের আনুপাতিক হারও খুবই গুরুত্ব l অবশ্যই অনলাইন ক্লাসের জন্য ইন্টারনেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় l কিন্তু এটাও সত্য যে, শুধু অনলাইন কেন, অফলাইন ক্লাসের জন্যও ইন্টারনেট অতীব জরুরী l বর্তমান সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য সার্চ করে তাদের আলোচ্য বিষয়গুলো আপডেট করে থাকে l কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শ্রেণিকক্ষে ইন্টারনেট কিংবা কম্পিউটার নেই বললেই চলে l লাইব্রেরীতে নেই পর্যাপ্ত সর্বশেষ সংস্করণের বই l অর্থাৎ যেখানে অফলাইন বা প্রচলিত পদ্ধতিতে ক্লাস পরিচালনা করাই অনেকটা কষ্টসাধ্য - সেখানে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করতে গেলে কি ধরনের অবকাঠামোগত পরিবর্তন করা দরকার তা নিশ্চয়ই অনুমেয় l তাহলে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমরা কি ক্লাস নেব না ? অবশ্যই নেব l স্বল্প পরিসরে হলেও সমাধানের পথ অর্থাৎ অনলাইনের দিকে আমাদের যেতেই হবে - যা ইতিমধ্যেই সমাধান করে কার্যক্রম শুরু করেছে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় l
এবার আসা যাক ইন্টারনেট, ল্যাপটপ/স্মার্ট ডিভাইস ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দিকে l পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ (প্রায় ৮০%) শিক্ষার্থী আসে গ্রামাঞ্চল থেকে এবং শহরে এসে টিউশনী কিংবা অন্য কোনো কাজ করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে থাকে l এমনকি অনেকে তাদের গরিব পিতা-মাতাকেও সাহায্য করে থাকে l এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা। এসব শিক্ষার্থীদের অনেকেরই নেই ল্যাপটপ বা স্মার্ট ডিভাইস l পক্ষান্তরে করোনার এই পরিস্থিতিতে গ্রামাঞ্চলে থাকা অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল গরিব শিক্ষার্থীদের পক্ষে উচ্চমূল্যে ডাটা (ইন্টারনেট) ক্রয় করে অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হওয়া সম্ভব ন্য় l তাই বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পূর্বে প্রথমেই নজর দিতে হবে ইন্টারনেট অবকাঠামোর দিকে l শ্রেণিকক্ষে ইন্টারনেট সংযোগ, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে সহজলভ্য (সম্ভব হলে করোনাকালীন সময়ে বিনামূল্যে) ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিন্ত করা l শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্প সুদে অর্থের জোগান দেওয়া - যাতে সে ল্যাপটপ কিনতে পারে l অর্থাৎ গৃহীত যে কোনো ব্যবস্থা বা পদ্ধতিতে সমতা, অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকা বাঞ্ছনীয় l দ্বিতীয়ত: মেডিকেল সেন্টারের উন্নয়নের দিকে l বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত হাসপাতাল তথা মেডিকেল সেন্টারকে কি নামে অভিহিত করা যায় তা বলাই বাহুল্য l বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মেডিকেল সেন্টার থেকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী করোনা সংক্রান্ত কোনো বিধি-নিষেধই পালন করা সম্ভব নয় l তাই নজর দিতে হবে মেডিকেল সেন্টারের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের সহজলভ্যতা ও প্রাপ্যতার দিকে l সেই সাথে থাকতে হবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান l এছাড়া আছে একাডেমিক ভবনের প্রবেশমুখে এবং শ্রেণিকক্ষে ঢোকার ও বাহির হওয়ার স্বাস্থ্যবিধির সরঞ্জাম স্থাপন করা এবং মেনে চলার বিষয় l প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান থাকলে ইন্টারনেট ও হাসপাতালসহ বর্ণিত অবকাঠামোগুলো উন্নয়ন করতে কমপক্ষে তিন থেকে ছয়মাস সময় লাগতে পারে l
অনলাইন ক্লাসের জন্য দরকার অনলাইন ভিত্তিক লাইব্রেরী l শিক্ষার্থীরা যাতে সহজেই ই-বুক, ই-জার্নালের এক্সেস পেতে পারে - সে দিকেও নজর দিতে হবে l সম্মানিত শিক্ষকগনও তাদের লেকচার নোট আপলোড করে দিতে হবে নির্দিষ্ট ওয়েবপোর্টালে l ছাত্র-শিক্ষক উভয়কেই স্ব-স্ব স্থানে এসব ডিজিটাল পদ্ধতির পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে l ক্রমে ক্রমে অনলাইনে পরীক্ষা ও ফলাফল প্রস্তুতির দিকেও এগোতে হবে l বেতন, পরীক্ষার ফি, বৃত্তির টাকা সহ যাবতীয় ফাইনান্সিয়াল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ই-ব্যাংকিং এর দিকে অগ্রসর হতে হবে l প্রয়োজনে নগদ, বিকাশ, রকেট, ইউক্যাশ, শিওরক্যাশ সহ দেশে বিদ্যমান যাবতীয় ই-পেমেন্ট সিস্টেমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্ট সিস্টেমের সাথে ইন্টিগ্রেটেড করে দিতে হবে l আরো ভালো হয় যদি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মঞ্জুরী কমিশন থেকে একটি ইউনিক অনলাইন প্লাটফর্ম সরবরাহ করা হয় l ভবিষ্যতে করোনা ছাড়া অন্য কোনো দুর্যোগ দেখা দিতে পারে l তাই সব সময়ের জন্য কিছু কোর্স ও অফিশিয়াল কাজকর্ম অনলাইনে চলমান রাখতে হবে – যাতে ভবিষ্যতে এই কিছু থেকে সম্পূর্ণ অনলাইনে পরিচালনা করা সম্ভব হয় এবং বিশ্ববিদ্যালকে আর বন্ধ রাখতে না হয় l পরিশেষে প্রাইভেট এবং পাবলিক সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকার একটি আশু সমাধান দিতে পারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটকের সাথে আলাপ করে l গ্রামীণফোন, রবিসহ অন্যান্য ইন্টারনেট সংস্থাগুলিও শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসতে পারে এই দুর্যোগকালীন সময়ে l মনে রাখতে হবে ছাত্র, শিক্ষক, ইন্টারনেট সবই দেশের ও দশের তথা সরকারের সম্পত্তি l আর এই ছাত্ররাই একদিন হাল ধরবে দেশের -।
লেখক : পরিচালক (আইআইটি) এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় l