মঙ্গলবার, ১২ মে ২০২০
প্রথম পাতা » পরিবেশ ও জলবায়ু | শিরোনাম | সাবলিড » বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
বিবিসি২৪নিউজ,বিশেষ প্রতিবেদক,ঢাকা: বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদ ও অর্থনীতির গবেষকেরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি বোঝার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য ও বিশ্লেষণ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে খণ্ডিত তথ্য দেওয়া হচ্ছে। নীতিনির্ধারণ ও কর্মসূচি পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুত এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া দরকার।কোন শ্রেণি–পেশার মানুষ করোনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, কাদের মধ্যে সংক্রমণের হার কম, কারা মারা যাচ্ছেন, আক্রান্তদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠেছে কি না, কাদের ভেতর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি বেশি প্রতিপালিত হচ্ছে—এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা জানতে ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজটিও এখনো হয়নি। এসব ব্যাপারে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরাও অনেকটা অন্ধকারে আছেন।
রোগের প্রাদুর্ভাব বিষয়ে সরকারি তথ্যের প্রধান উৎস রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। নিপাহ্, অ্যানথ্রাক্স, চিকুনগুনিয়া, বার্ড ফ্লু—এসব রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় সরকারি এই প্রতিষ্ঠান তথ্য দিয়েছে, দেশবাসীর সামনে বিশ্লেষণ হাজির করেছে। গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময়ও আইইডিসিআর তথ্যের পাশাপাশি কিছু বিশ্লেষণ দিয়েছে। কিন্তু করোনার এই মহামারি পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে বড় ধরনের কোনো বিশ্লেষণ বা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বর্তমানে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার সমন্বয়ের দায়িত্বেও আইইডিসিআর নেই। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যার বিষয়টি অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তা আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের সংবাদ বুলেটিন থেকে জানতে পারছি। মোট আক্রান্তের মধ্যে কতজন পোশাক কারখানার কর্মী, অথবা কতজন বস্তিতে বাস করেন—এ রকম তথ্যও থাকা দরকার। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে কর্মসূচি পরিবর্তন বা নতুন কর্মসূচি হাতে নেওয়া যায়।
জনমিতি, আবহাওয়াসহ নানা কারণে দেশভেদে পরিস্থিতির ভিন্নতা থাকতে পারে। সে জন্য বাংলাদেশের সঠিক পরিস্থিতি জানার জন্য তথ্য দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ করোনা সংক্রমণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে ছোট পরিসরে কিছু গবেষণা করেছে। ইতিমধ্যে তারা কিছু গবেষণার ফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশও করেছে। এ ছাড়া অন্তত একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণেরও কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা ও মুগদা মেডিকেল কলেজও গবেষণা শুরু করেছে। এসব গবেষণার সঙ্গে জড়িতরাও বলছেন, করোনায় আক্রান্তদের বিষয়ে তথ্য বিশ্লেষণ জরুরি।
গবেষণা চলছে বিশ্বজুড়ে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং পরবর্তী সময় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় সারা বিশ্বের জবস্বাস্থ্যবিদ, রোগতত্ত্ববিদ, ওষুধবিজ্ঞানী, জিনবিজ্ঞানী, সমাজ ও অর্থনীতির গবেষকেরা নতুন নতুন পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও গবেষণায় যুক্ত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই নতুন তথ্য, বিশ্লেষণ মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটা হওয়া দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ১ লাখ ২৯ হাজার ৮৬৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত ১৫ হাজার ৬৯১ জন। মারা গেছেন ২৩৯ জন। সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৯০২ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক তথ্য পাওয়া সম্ভব এবং তা দরকার।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক সংক্রমণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সমাজের কোন স্তরের মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বেশি হচ্ছে, সেই তথ্য জানা যাচ্ছে না।’ কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এসব বিষয়ে এখনো স্পষ্ট করে কিছু প্রকাশ করেনি।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতেন আইইডিসিআরের কর্মীরা। তাঁরা একটি ফর্ম পূরণ করতেন। তাতে রোগীর নাম, ঠিকানাসহ নানা তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা আছে। আইইডিসিআরের একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফর্ম অনুসরণ করে ফর্মটি তৈরি করা। তবে তার সঙ্গে বাড়তি কিছু তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থাও আছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নমুনা সংগ্রহের ফর্মটি গবেষণা বা বিশ্লেষণের কাজে লাগানোর জন্য একটি বড় উপাদান। অবশ্য এই ফর্মের ভিত্তিতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু তথ্য দিচ্ছে।
আইইডিসিআর তাদের ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে, নমুনা পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলাফলের সংখ্যা, দৈনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, মোট আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে নারী–পুরুষ ও বয়সের বিভাজন, মোট মৃত ব্যক্তির নারী–পুরুষ ও বয়সের বিভাজন। এ ছাড়া কোন জেলায় এবং ঢাকা শহরের কোথায় কত রোগী, তার তথ্য আছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লিঙ্গ পরিচয়, বয়স বিভাজন ও ভৌগোলিক বিভাজনের তথ্য তাঁদের কাজ লাগছে।
১৪ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড–১৯ বিষয়ক হালনাগাদ কৌশলপত্রে বলেছিল, ৪০ শতাংশ রোগীর লক্ষণ থাকে মৃদু, ৪০ শতাংশের মাঝারি। ১৫ শতাংশ রোগীর লক্ষণ–উপসর্গ থাকে তীব্র এবং বাকি ৫ শতাংশের জটিল। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এটি বৈশ্বিক গড় পরিস্থিতি। জনমিতি, আবহাওয়াসহ নানা কারণে দেশভেদে পরিস্থিতির ভিন্নতা থাকতে পারে। সে জন্য বাংলাদেশের সঠিক পরিস্থিতি জানার জন্য তথ্য দরকার।
কোভিড–১৯ রোগীর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষণ–উপসর্গ দেখে চিকিৎসকেরা ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন। একাধিক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রায় প্রত্যেক রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন দুজন রোগী বলেছেন, তাঁদের উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে বলা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেছেন, ‘আপাতত দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম। কেন কম, তার ব্যাখ্যা এখনো কেউ দিতে পারছেন না। তবে শনাক্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ও বাড়িতে যে ওষুধ তাঁরা সেবন করছেন, তা নিয়ে অনুসন্ধান হতেই পারে।’
তবে এসব ব্যাপারে জানার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ এবং আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সেবা বিভাগ) হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘পোশাককর্মী বা বস্তিবাসীদের ব্যাপারে কথা বলার সময় অনুমাননির্ভর না হয়ে তথ্যভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। আগামীতে কোনো সভায় বিষয়টি আমি তুলে ধরার চেষ্টা করব।’
ভাইরাসটির নতুনত্ব প্রতিদিনই প্রমাণিত হচ্ছে, আসছে নতুন নতুন তথ্য। অনেকেই ধারণা করছেন, বিশ্বের সব প্রান্তে ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা সমান নয়। ভৌগোলিক অবস্থা, আবহাওয়াসহ আরও কিছু কারণে এর জিনগত পরিবর্তন ঘটে থাকতে পারে।
দেশে একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা ভাইরাসটির জিন বিশ্লেষণ বা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ শুরু করেছেন। আইইডিসিআর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব গবেষণার ফলাফল পাওয়া গেলে এটা জানার সম্ভাবনা আছে যে ভাইরাসটি এ দেশে কোন চরিত্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার নতুন পন্থাও পাওয়া যেতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘করোনা মহামারি অনেক বড় ঘটনা। এর ব্যাপ্তি অনেক বড়, তাৎপর্য অনেক গভীর। এসব বুঝতে হলে সুনির্দিষ্ট তথ্য–উপাত্তের সঙ্গে দরকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ।