মঙ্গলবার, ৭ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » ছুটির দিনে | জীবনযাপন | প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের মহামারিতে এক মাস টিকে থাকার মতো সঞ্চয় নেই!
নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের মহামারিতে এক মাস টিকে থাকার মতো সঞ্চয় নেই!
বিবিসি২৪নিউজ,তুহিন আহমেদ: বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য সরকার গত ২৭ মার্চ থেকে সারা দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকাগুলো এখন এমন। ঢাকায় অথবা মফস্বলে থাকা এ রকম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজনের সংখ্যা কত, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। প্রতিদিন এ রকম অনেক মানুষ সহায়তার অনুরোধ জানাচ্ছেন। এসব নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের মহামারির সময় এক মাস টিকে থাকার মতো সঞ্চয় নেই।যে গলিতে থাকি, সেখান থেকে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ফল বিক্রেতা, টংঘরের চায়ের দোকানদার, ভ্যানগাড়ির সবজি বিক্রেতা, বাদাম-বুট-ছোলা বিক্রেতা, জুতা সেলাইয়ের কারিগর, সেলুনের কর্মী থেকে অসংখ্য পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে রোজ দেখা হয়। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার চোখাচোখি হয়, কারও সঙ্গে কথা হয়, অনেকের ভালোমন্দের খবরও শুনি।
জীবন এদের একটু আয়েশ করে পা ছড়িয়ে গল্প করার ফুসরত দেয়নি। উদয় অস্ত খেটে তিন বেলা ভাত, মোটা কাপড়, থাকার জন্য সামান্য একটু জায়গা জোগাড় করতে গিয়ে এদের চুল পাকে, ডায়বেটিস হয়—তারপর অলক্ষ্যে যেমন ঝরে যায় বুনো ফুল, এরাও একদিন টুপ করে মরে যায়। এদের মরে যাওয়ার পর ঘটা করে শেষকৃত্য হয় না, এদের অধিকাংশের ফেসবুক নেই; তাই ফেসবুক রিমেম্বারিংও হয় না। এরা বাংলাদেশের আম আদমি। এরা ১৬ কোটি মানুষের বিপুল অংশ হলেও এরা সমাজের মধ্যে বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়ার কোনোটিই মালুম হয় না। এরা হলো ‘অপার’ মানুষ। সমাজের আউটসাইডার। এই অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অবরুদ্ধ রাজধানীতে এই অপার, আউটসাইডার গরিব মানুষগুলো গেল কোথায়?
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রথম দিনে রাস্তায় নেমে এদের কারও সঙ্গে আমার দেখা হয় না আর। অথচ জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে যে পিঠা বিক্রেতা একদিন ফুটপাতে না বসলে যার ঘরের চুলায় হাঁড়ি ওঠে না, তিনি গেলেন কোথায়? জানতে ইচ্ছে করে, এই যে সবজি বিক্রেতা, বাদাম বিক্রেতা, পাড়ার মোড়ের স্যালনের কর্মী, ৮ নম্বর ৯ নম্বর বাসের কন্ডাক্টর, তারা গেল কোথায়? যে বাসায় থাকি সেখানে একজন দুধ বিক্রেতা প্রতিদিন একটি রিকশা করে দুধ দিতে আসতেন। তিনি কোথায় গেলেন?
২৬ মার্চ থেকে কার্যত থেমে আছে দেশ। যাদের কাছে পর্যাপ্ত জমানো অর্থ নেই তাদের পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক তা অনেকে আঁচ করতে পারছেন না। সরকার কত মানুষকে সহায়তা দিচ্ছেন, কোন জেলায়, কোন উপজেলায় কত, তার হিসাব আমরা জানি না। অথচ দেশের সাধারণ খেটে-খাওয়া কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেরানিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভয়াবহ সংকটের এই সময় সমাজের সব থেকে বড় এই অংশের জন্য রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কোনো প্যাকেজের কথা এখন পর্যস্ত শোনা যায়নি।
অথচ সংকট শুরুর প্রথম দিকেই রাষ্ট্রের ধনিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা এসেছে। তারপরও তারা কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়নি। চাকরি বাঁচাতে হাজার হাজার শ্রমিকের অনেকে হেঁটে ঢাকা এসেছেন। কী ভয়াবহ ধনিক শ্রেণি। অন্যদিকে কৃষি ও কৃষক দুটোই বেসরকারি খাত বা প্রাইভেট সেক্টর। কিন্তু সেখানকার কোনো প্যাকেজ নেই কেন?
ইউরোপে একটি গরুর পেছনে বছরে ভর্তুকি ৭০ হাজার টাকা। ভারতীয় সাংবাদিক পি সাইনাথ একবার এক ভারতীয় কৃষক সংগঠককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভারতীয় কৃষকের স্বপ্ন কী?’ উত্তর এসেছিল, ‘পরের জন্মে ইংল্যান্ডের গরু হয়ে জন্ম নেওয়া।’
এ দেশে অদ্ভুত একটা প্রাইভেট সেক্টর হলো কৃষি। ধরুন, আপনি যদি একটা বদনাও তৈরি করেন, তাহলে বদনার দাম উৎপাদন ঠিক করতে পারবেন। সেই দামের মধ্যে মূলধন, শ্রমিকের শ্রম, কাঁচামালসহ নানান কিছুর পর লাভ ধরে দাম ঠিক করা হবে। কিন্তু একমাত্র কৃষকই ধান, লাউ, বেগুন, আলু যা-ই উৎপাদন করুক, তার দাম সে নির্ধারণ করতে পারে না, সেটা করবে ফড়িয়ারা। তাহলে কৃষক উৎপাদক নয়? প্রতিবছর লোকসান করে আবার সে ফসল ফলায়। এক বছর এই ফসল ফলানো বন্ধ থাকলে গোটা জাতির খাদ্য কি বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব? তখন কি খাদ্যের বদলে মানুষ টাকা খাবে?
এই করোনা মহামারির সময় সেই সব অগণিত কৃষকের কথা মনে পড়ছে। তারা কোথায়? কী করছে তারা? দেশের ৮০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আসে পোশাক খাত থেকে। অথচ এশিয়ার মধ্যে এ খাতের শ্রমিকেরা সব থেকে কম বেতন পান। ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে (ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্ক স্টাডি-২০১৭), সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করেন গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকেরা। শুধু যেসব কারখানা নিজেরা সরাসরি রপ্তানি করে, তাদের শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যেসব গার্মেন্টস অন্যের কাজ করে দেয়, তারা কী করবে? কিংবা যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশে পণ্য পাঠায় না, সেসব কারখানার শ্রমিকেরা কী করবে?
দুনিয়ায় মানুষের চেয়ে দামি আর কিছু নেই। যদি অসুস্থ হলে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, তাহলে ওই সম্পদের সঙ্গে সাধারণ মাটির কী ফারাক আছে? কোনটা বেশি দরকার—স্বাস্থ্যসেবা না উন্নয়ন? উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, তবে আগে স্বাস্থ্যসেবা দরকার।