বুধবার, ১ এপ্রিল ২০২০
প্রথম পাতা » বিশেষ প্রতিবেদন | শিরোনাম | সাবলিড | স্বাস্থ্যকথা » করোনাভাইরাস নিয়ে ভ্যাকসিন ঝুঁকি ১৮ মাস ?
করোনাভাইরাস নিয়ে ভ্যাকসিন ঝুঁকি ১৮ মাস ?
বিবিসি২৪নিউজ,আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে বিশ্বে প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। তবে ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যর্থতার ইতিহাসও অজানা নয়। ভ্যাকসিন নিরাপদ না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
করোনাভাইরাস নিয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এক ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠান এই ভ্যাকসিন তৈরির পেছনে ছুটতে শুরু করেছে। বোস্টন চিলড্রেনস হাসপাতালের গবেষক ডেভিড ডাউলিং বলেছেন, টানা ১৭ ঘণ্টা করে কাজ করছেন তাঁরা। করোনাভাইরাসের জন্য নিখুঁত ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে যা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা বয়স্কদের সুরক্ষা দিতে পারবেন।
১৯৬০ সালে হিউম্যান রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) পরীক্ষার সময় অনেক নবজাতকের ক্ষেত্রে খারাপ উপসর্গ দেখা যায়। দুটি নবজাতক মারা যায়। ১৯৭৬ সালেও নভেল সোয়াইন ফ্লুর ভ্যাকসিন পরীক্ষা করতে গিয়ে ৩০ জন মারা যান এবং অনেকের শরীর প্যারালাইসিস হয়ে যায়। ২০১৭ সালেও ফিলিপাইনে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন পরীক্ষা নিরাপত্তার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৮ মাস অনেক দীর্ঘ সময় মনে হতে পারে। কিন্তু ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথা চিন্তা করলে একে খুব স্বল্প সময়ই বলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য এতটুকু সময়ের কথাই বলছে। তবে এ খাতের নেতারা বলছেন, এটা খুব তড়িঘড়ি হয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করেই তবে ভ্যাকসিন হাতে আসতে পারে।
গত সপ্তাহে ভ্যাকসিন তৈরির এ সময়সীমার কথা সংবাদের শিরোনাম হয়। ওই সময় ট্রাম্প ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক সভা করে ঘোষণা দেন, তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে যাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্থনি এস ফাউসি টিভি ক্যামেরার সামনে ট্রাম্পের ওই পূর্বাভাসে ওপর জল ঢেলে দেন। তিনি বলেন, তিন-চার মাসে ভ্যাকসিন হবে না, এটা তৈরিতে অন্তত এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। সেই থেকে গণমাধ্যমে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই করোনাভাইরাসে ভ্যাকসিন আসছে বলে খবর প্রচার করা হচ্ছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন তৈরির প্রথম অভিজ্ঞতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন।
বেইলার কলেজ অব মেডিসিনের সংক্রামক রোগ এবং ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ ড. পিটার হোটেজ বলেন, ‘ফাউসি এক থেকে দেড় বছরের যে সময়সীমার কথা বলেছেন, এটি আমি আশাবাদ বলে মনে করি। তবে সম্ভবত আরও বেশি সময় লাগতে পারে।’
রোটাভাইরাস ভ্যাকসিনের সহ-উদ্ভাবক ড. পল ওফিটের ভাষ্য, ‘ফাউসি যখন করোনাভাইরাস নিয়ে সময়সীমার কথা বলেছিল, তখন আমি একে হাস্যকর আশাবাদ বলে মনে করেছিলাম। আমি নিশ্চিত, তিনিও তা–ই মনে করবেন।’
ভ্যাকসিন তৈরির হিসাব সাধারণত বছরের হিসাবেই করা হয়। এখানে মাসের হিসাব আসে না। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ভ্যাকসিন খুঁজে পাওয়ার জন্য বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেক প্রতিষ্ঠান মর্ডানা গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য সরকারি গবেষকদের কাছে পাঠিয়েছিল। এ মাসের শুরুর দিকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ডোজ স্বেচ্ছাসেবকদের দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের জেনিফার হলারের ওপর করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। সিয়াটলের কায়সার পার্মানেন্তে ওয়াশিংটন রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম ইনজেকশনের মাধ্যমে টিকা নেন হলার।
মর্ডানাস ‘এমআরএনএ-১২৭৩’ নামের ভ্যাকসিনটিতে সার্স-সিওভি-২ করোনাভাইরাস থেকে মেসেঞ্জার আরএনএর নিষ্ক্রিয় খণ্ড ব্যবহার করা হয়। এ পরীক্ষার প্রথম দফার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের শরীরের জন্য নিরাপদ কি না, তা পরীক্ষা করা। গবেষকেরা দাবি করেন, এতে ভাইরাসের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় সংক্রমণের ঝুঁকি নেই। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে কায়সার পারমানেন্তের গবেষক লিসা জ্যাকসনের নেতৃত্বে একদল গবেষক এ ভ্যাকসিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কতখানি কার্যকর, তা পরীক্ষা করে দেখবেন।
গত শুক্রবার আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ৪৫ জন স্বেচ্ছাসেবক সিয়াটল ও আটলান্টায় প্রথম ধাপের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ ফাউসি, রেকর্ড গতিতে করোনা ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য এ ব্যবস্থা করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিবৃত সময়সূচি সর্বোচ্চ উচ্চাভিলাষী।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ আমেশ আদালজা বলেন, ‘শিল্প খাতের পর্যায়ে উৎপাদনে গেলেও ১৮ মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন উৎপাদন কখনো হয়নি। এটা মাসের হিসাবে নয়, বছরের হিসাবে ধরা হয়।’
কোনো ভ্যাকসিন মানবদেহে তিন ধাপের প্রক্রিয়া শুরুর আগে কোনো প্রাণীর ওপর পরীক্ষা শেষ করতে হয়। প্রথম ধাপে অল্প কিছু মানুষের ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে এটি নিরাপদ কি না এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা নির্ণয় করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে কয়েক শ মানুষের ওপর এটি পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে এর ঝুঁকি নির্ণয় করে দেখা হয়। যদি এ ধাপে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়, তবে ভ্যাকসিন পরীক্ষা তৃতীয় ধাপে করার জন্য প্রস্তুত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় ধাপে কয়েক হাজার মানুষের ওপর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও সুরক্ষা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. এমিলি আরবেল্ডিং বলেন, ‘সাধারণত ভ্যাকসিন তৈরিতে ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। তবে আমাদের মনে হয়, ১৮ মাসে আমরা দ্রুততার সঙ্গে এগোতে পারি। এ সময় সব ধরনের তথ্যের ওপর তাকানোর সুযোগ থাকে কম। যেহেতু মহামারি মোকাবিলার একটি প্রতিযোগিতায় আছি এবং একটি ভ্যাকসিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোকেরা দ্রুত দ্বিতীয় পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ নিতে ইচ্ছুক হতে পারে। সুতরাং ১৮ মাস সময় সবকিছুই দ্রুতগতিতে হওয়ার ওপর নির্ভর করে।’
এমিলি আরবেল্ডিং আরও বলেন, সুরক্ষার জন্য প্রতিটি পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবীদের নজরদারি করা দরকার। সাধারণত, আপনি কমপক্ষে এক বছরের জন্য তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনুসরণ করতে চাইবেন।
এমিলির কথার প্রতিধ্বনি নেই সিয়াটল ও আটলান্টায়। স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট স্ট্যাট জানিয়েছে, সিয়াটল ও আটলান্টায় পশু ও মানুষের ওপর একই সঙ্গে গবেষণা চালানো হচ্ছে। সিএনএনের পক্ষ থেকে কায়সার পারমানেন্তের কাছে ভ্যাকসিনের বাজার আসার সময় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ওয়াল্ট ওরেনস্টেইন বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন। এটি কোনো সহজ সিদ্ধান্ত নয়, চলমান বিষয়ের ওপর লক্ষ্য করে এটা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে করা হচ্ছে। যদিও সার্স ও মার্স ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা থেকে তাদের শিক্ষণীয় রয়েছে তবে ১৮ মাসে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা কঠিন। তবে সবকিছু দ্রুতগতিতে হবে, কারণ দাবানলের মতো করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে বিরল ক্ষেত্রে, ত্রুটিযুক্ত ভ্যাকসিনের পরীক্ষা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক বা প্রাণঘাতী প্রমাণিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক এইডস ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভের সভাপতি এবং প্রধান নির্বাহী মার্ক ফেইনবার্গ স্ট্যাটকে বলেছেন, কোনো পশুর ওপর পরীক্ষা গুরুত্ব থাকলেও জরুরি অবস্থা বিবেচনায় এটি বাজারে আনার যোগ্য। তবে যখন সীমিত সময়সীমা থাকে, তখন নতুন পদ্ধতি গ্রহণ না করলে সে লক্ষ্যে পৌঁছানো দুঃসাধ্য হয়ে যায়।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে একেবারে আনকোরা পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রযুক্তি আগে কখনো অনুমোদন পায়নি। বৈপ্লবিক প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্ম যদি সফল হয়, তবে এর উন্নয়নে দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হবে। এ প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘মেসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন’। মর্ডানা ও এনআইএআইডির গবেষকেরা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যাতে জীবিত ভাইরাসের কোনো অংশ ব্যবহার করা হয় না। এর বদলে চীনের দেওয়া করোনাভাইরাসের জেনেটিক তথ্য ব্যবহার করা হয়। একে বলা হচ্ছে ‘এমআরএনএ-১২৭৩’, যা শরীরের কোষকে প্রোটিন তৈরি করতে নির্দেশ দেয় এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বিশেষজ্ঞ আমেশ আদালজা বলেন, এটি খুব মার্জিত সমাধান। এ কারণেই তারা এত তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিনের পরীক্ষায় যেতে পারে। তাদের কেবল ভাইরাসটির সিকোয়েন্স প্রয়োজন হয়। তবে এ পদ্ধতিতেও ১৮ মাসের বেশি সময় লাগতে পারে বলে মনে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও উৎপাদনের বিষয়গুলো যুক্ত রয়েছে।
ফিলাডেলফিয়ার চিলড্রেনস হাসপাতালের ভ্যাকসিন এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক ওফিট সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ‘তড়িঘড়ি করতে গিয়ে আমরা যেন ভালোর চেয়ে খারাপ করে না বসি। আমরা সুস্থ মানুষের ওপর এপি প্রয়োগ করছি। তাই এর নিরাপত্তা সর্বোচ্চ মানের হতে হবে।’
জানুয়ারি মাসে যখন করোনাভাইরাসের বিষয়টি জানা গেল তখন ল্যাবের পক্ষ থেকে এর ভ্যাকসিন নিয়ে কাজের অনুমতি চাওয়া হলে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয় এবং দ্রুত কাজ করতে বলা হয়।