বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » বিশেষ প্রতিবেদন » ভারতের আদমশুমারি কি আদৌ সুষ্ঠুভাবে হবে?
ভারতের আদমশুমারি কি আদৌ সুষ্ঠুভাবে হবে?
বিবিসি২৪নিউজ,বিশেষ প্রতিনিধি:ভারতে সেই ১৮৭২ সাল থেকে প্রতি দশকের শুরুতেই যে আদমশুমারি বা জনগণনার কাজ হয়ে আসছে, এই প্রথমবারের মতো তার সুষ্ঠু সম্পাদন নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।মাসদেড়েক আগেই কেন্দ্রীয় সরকার পরবর্তী আদমশুমারির সময়সূচী ঘোষণা করেছে, কিন্তু তার সঙ্গেই এবার যেহেতু এনপিআর বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের তথ্য সংগ্রহকেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে - সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভয় ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।গত কয়েক সপ্তাহে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে নানা জরিপের তথ্য সংগ্রাহকদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে - তাতে অ্যাক্টিভিস্ট ও এনজিও কর্মীরা একবাক্যে বলছেন, সরকার এই ভয় দূর করতে না-পারলে আদমশুমারির পুরো প্রক্রিয়াটাই হুমকির মুখে পড়বে।
দেশভাগেরও আগে, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে গত প্রায় দেড়শো বছর ধরে ভারতে সেন্সাস বা আদমশুমারি হয়ে আসছে - তেমন বড় কোনও রাজনৈতিক বিতর্ক ছাড়াই।কিন্তু ২০২১-এর আসন্ন সেন্সাস সেদিক থেকে একটি বড় ব্যতিক্রম।
কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর গত ডিসেম্বরেই ঘোষণা করেছিলেন, “এপ্রিল থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেন্সাসের ডেটা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়ে যাবে। আর তার একই সঙ্গে চলবে এনপিআর বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের তথ্য সংগ্রহ।যেহেতু সেন্সাসের সঙ্গে সরকার এবার এনপিআরকে জুড়ে দিতে চাইছে, তাতেই চরম আতঙ্কিত বোধ করছেন ভারতের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ।
কারণ, এনপিআর-কে তারা দেশব্যাপী জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা প্রস্তাবিত এনআরসি-র প্রথম ধাপ হিসেবেই দেখছেন।অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মসের উজ্জয়িনী হালিম বিবিসিকে বলছিলেন, “সেন্সাস নিয়ে মানুষের মনে সেভাবে ভীতি না-থাকলেও এবারের সেন্সাসকে তারা এনআরসি প্রস্তুত করার একটি হাতিয়ার হিসেবেই দেখছেন।সরকারি ওয়েবসাইটে কিছুদিন আগেও খুব স্পষ্ট করে লেখা ছিল এনপিআর হল এনআরসি-রই প্রথম পদক্ষেপ। তো যতক্ষণ না সরকার এটা পরিষ্কার করে বলছে যে দুটো আলাদা জিনিস, ততক্ষণ ভয় তো একটা থাকবেই।” “পশ্চিমবঙ্গে আমরা সম্প্রতি বারে বারে দেখেছি স্বাস্থ্য নিয়ে সার্ভে করতে গিয়েও কর্মীরা গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন, সামান্য কোনও তথ্য জানতে গিয়েও তারা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।”
এনআরসি-এনপিআর নিয়ে মানুষের মনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, স্পষ্টতই এই সব হামলা তারই বহি:প্রকাশ।বস্তুত শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গত কয়েকদিনে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, কর্নাটক-সহ নানা রাজ্যেই ফিল্ড লেভেলে তথ্য সংগ্রহকারীরা আক্রমণের মুখে পড়েছেন।
হামলার ভয়ে অন্ধ্র ও পশ্চিমবঙ্গে থমকে গেছে ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে’ বা এনএসএস-এর কাজ।
অ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনীতিবিদ কবিতা কৃষ্ণন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “যদিও এই সব আক্রমণ সমর্থনযোগ্য নয় - কিন্তু মানুষের ভয়টা দূর করার দায়িত্ব কিন্তু সরকারেরই।” “যতক্ষণ না এনআরসি-এনপিআর আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষিত হচ্ছে, ততক্ষণ সেন্সাসও বন্ধ রাখতে হবে।”
“কারণ সেন্সাসে সরকারের কোনও ক্ষমতা নেই এ দেশের কোনও বাসিন্দাকে সন্দেহজনক নাগরিক বলে চিহ্নিত করার - কিন্তু এনপিআরে ঠিক সেই ক্ষমতাটাই একজন সাধারণ কর্মকর্তাকে দেওয়া হচ্ছে।মানুষ কেন ভয় পাচ্ছে তা বোঝা তা-ই শক্ত নয়”, মন্তব্য মিস কৃষ্ণানের।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ নানা রাজ্যেই শিল্পী-অভিনেতা-তারকারা ইতিমধ্যে আওয়াজ তুলেছেন, সরকার যা-ই বলুক, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে দেশের মানুষ কিছুতেই তাদের বংশপরিচয়-দলিল-নথিপত্র ইত্যাদি, এক কথায় ‘কাগজ’ দেখাবেন না।তবে এর ফলে শুধু সরকারি সংস্থাগুলোই নয় - এখন কিন্তু প্রায় গোটা দেশেই কোনও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সার্ভে করা, জরিপ চালানো এনজিও-গুলোর জন্যও অসম্ভব হয়ে উঠেছে, জানাচ্ছেন উজ্জয়িনী হালিম।ড: হালিমের কথায়, “যাদের আমরা সার্ভে করতে পাঠাব তাদেরকে আমরা একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না।
“যেমন গ্রামোন্নয়নের কাজে আমাদের একটা জরিপ করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সত্যি কথা বলতে তৃণমূল স্তরে আমরা যে কর্মীদের পাঠাব সেই পরিস্থিতিটাই কিন্তু এখন নেই।এনজিও-গুলো সেই ভরসা-টাই পাচ্ছে না যে অতি সাধারণ একটা সার্ভেও তারা করতে পারবে। সামান্য একটা সচেতনতা শিবির বা তৃণমূল পর্যায়ে একটা মিটিং করতে গেলেও আজকাল হাজারটা প্রশ্নের মুখে তাদের পড়তে হচ্ছে”, বলছিলেন তিনি।
প্রায় ১৩৪ কোটি মানুষের দেশ ভারতে আদমশুমারি বিশ্বের বৃহত্তম তথ্য সংগ্রহ অভিযানগুলোর একটি।