বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রিয়দেশ | রাজনীতি | শিরোনাম | সাবলিড » ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা বিএনপির
ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা বিএনপির
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা: ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টার অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে দলটি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন এবং ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে আরও দলের সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে।
একসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক ছিল খেলাফত মজলিস। ২০২১ সালের অক্টোবরে একটি ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ তারা জোট ছেড়ে যায়। তিন বছর পর গতকাল দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হলো। এই বৈঠকে বিএনপির পক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে দলটির নয়জন নেতা বৈঠকে অংশ নেন।
আমরা ইসলামি দলগুলো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছি। এটা তারই অংশ। যদিও বৈঠকটি ছিল সৌজন্যমূলক। জামায়াত আমিরের বরিশালে কর্মসূচি ছিল। তবু দুই দলের আমিররা বৈঠক করেছেন, একসঙ্গে প্রেস ব্রিফিং করেছেন। এর একটা তাৎপর্য আছে। আমরা এটাকে শুভসূচনা বলেই মনে করি।
ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান
বিএনপি তার পুরোনো জোটসঙ্গী খেলাফত মজলিসের সঙ্গে এমন সময় বৈঠক করল, যখন এক দিন আগে গত মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বরিশালে চরমোনাইয়ের পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাঁরা মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। অবশ্য বরিশালে জামায়াতের আমিরের দলীয় সমাবেশ ছিল। এর ফাঁকে তাঁরা চরমোনাইতে মিলিত হন। যদিও ইসলামপন্থী এ দুটি দলের মধ্যে আদর্শিক বিরোধ রয়েছে। ৫ আগস্টের পর দল দুটিকে পরস্পরের প্রতি নমনীয় দেখা যায়। এর মধ্যেই জামায়াতের কোনো আমির ও বা শীর্ষ পর্যায়ের নেতা প্রথমবারের মতো চরমোনাইয়ের পীর বাড়িতে আতিথেয়তা নিলেন। পরস্পর বৈরী দল দুটির এই সম্পর্কোন্নয়নকে আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান গতকাল বুধবার বলেন, ‘আমরা ইসলামি দলগুলো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছি। এটা তারই অংশ। যদিও বৈঠকটি ছিল সৌজন্যমূলক। জামায়াত আমিরের বরিশালে কর্মসূচি ছিল। তবু দুই দলের আমিররা বৈঠক করেছেন, একসঙ্গে প্রেস ব্রিফিং করেছেন। এর একটা তাৎপর্য আছে। আমরা এটাকে শুভসূচনা বলেই মনে করি।’
গতকাল খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক শেষে জামায়াতের আমির ও ইসলামী আন্দোলনের আমিরের বৈঠকের বিষয়টি ব্রিফিংয়ে সামনে আনেন সাংবাদিকেরা। এ বিষয়ে তাঁরা বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানতে চান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিভিন্ন দলের সঙ্গে লিয়াজোঁর দায়িত্বে থাকা নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘বাংলাদেশে যাঁরাই রাজনীতি করেন, তাঁরা তাঁদের রাজনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাঁদের সঙ্গে মতের মিল হবে, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার চিন্তা করতে পারেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ নিয়ে কারও কোনো দুশ্চিন্তা থাকার তো কোনো কারণ নেই।’
অবশ্য চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে এ বৈঠকটিকে ‘চূড়ান্ত কিছু নয়’ বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘একসময় এক দল আরেক দলের বিরোধিতা করেছে, সমালোচনা করেছে, আবার আন্দোলনের একপর্যায়ে তারা একমত হয়েছে। এতে অস্বাভাবিক কী আছে! আজকে যারা একমত, কালকে তারা একমত না-ও হতে পারে। তাতে অবাক হওয়ার কী আছে! কাজেই এ বিষয়গুলো নিয়ে দুশ্চিন্তার বা মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তারা (জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন) তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে যা উচিত মনে করবে, নিশ্চয়ই তা করবে।’
অবশ্য চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে এ বৈঠকটিকে ‘চূড়ান্ত কিছু নয়’ বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি গত রাতে বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই গিয়েছি (চরমোনাইয়ের পীর), তাঁরাও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। এটা চূড়ান্ত কিছু নয়, আমরা সমঝোতায় এসে গেছি—এ রকমও নয়। বিষয়টি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি, তাঁরাও ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন।’
একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলন ও নির্বাচন করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামি দল। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের দুটি অংশ উল্লেখযোগ্য।
বিএনপি-খেলাফত একমত যেসব বিষয়ে
বিএনপি ও খেলাফত মজলিস—দুই দলই দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সাতটি বিষয়ে একমত হয়েছে। বৈঠক শেষে গুলশানের কার্যালয়ে যৌথ ব্রিফিংয়ে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের সেগুলো তুলে ধরেন। সেই সাতটি বিষয় হলো জাতীয় ঐক্য সুসংহত করার জন্য বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রাখা। বড় দল হিসেবে বিএনপিকেই এ উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া; ইসলামি মূল্যবোধ সমুন্নত ও ধর্মীয় সম্প্রীতির রক্ষায় সবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখা; পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য জাতীয় ঐক্য অটুট রাখা; খুন, গুম, হত্যা, নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা; বিগত আওয়ামী সরকারের সময় আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব বলেন, ‘জাতির স্বার্থে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি মনে করি। এ ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি।’
এর আগে বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খান কোন প্রেক্ষাপটে এবং কেন খেলাফত মজলিসের সঙ্গে এ বৈঠক, সে বিষয়ে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে কী করণীয়, সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একমত হয়েই একসঙ্গে আন্দোলন করেছি বহু বছর ধরে। এ আলোচনায় (গতকাল) আমাদের মধ্যে তেমন কোনো দ্বিমত নেই, আমরা একমতই হয়েছি।’
২০২১ সালে জোট ছাড়ার তিন বছর পর এই প্রথম খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বিএনপি আনুষ্ঠানিক বৈঠক করল; যদিও গত ডিসেম্বর মাসে দলটি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত তাদের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিবসহ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
বিএনপির সঙ্গে একটা বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কথা বলার পর যদি চিন্তাচেতনার ঐক্য তৈরি হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আমরা আপনাদের জানাব।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী
‘জোটচ্যুত’ অনেকের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠকটি ছিল বিএনপির উদ্যোগে। ওই সূত্র জানিয়েছে, বিগত সময়ে ‘জোটচ্যুত’ আরও দলের সঙ্গেও শিগগিরই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলন ও নির্বাচন করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামি দল। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের দুটি অংশ উল্লেখযোগ্য। শেষ পর্যন্ত এই সব কটি দল ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে বিএনপির জোট ছেড়ে যায়। যদিও যে কয়টা ইসলামি দল ২০-দলীয় জোটে ছিল, সেগুলো মূলত জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া দলগুলোর খণ্ডিত অংশ। যাদের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই।
এই দলগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে প্রথম বিএনপি জোট ছেড়ে যায় প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট। শায়খুল হাদিসের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোট ছাড়ে তারও বহু আগে। ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনার পর জোট ছাড়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। সহিংসতার ঘটনায় এ দুটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাকে মামলার আসামি করে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। চাপে তারা জোট ছেড়েছিল বলে তখন আলোচনা ছিল।
পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, বিএনপির জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রায় ৬০ জন নেতা জামিনে মুক্তি পান। আর খেলাফত মজলিস জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর কারামুক্ত হন দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের। এখন সে দলগুলোর কোনো কোনোটির সঙ্গে বিএনপি যোগাযোগ শুরু করেছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও বিএনপির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী গত রাতে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে একটা বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কথা বলার পর যদি চিন্তাচেতনার ঐক্য তৈরি হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আমরা আপনাদের জানাব।’
ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে জামায়াতে ইসলামীকে এড়িয়ে চলছে বিএনপি। এখনো তা অব্যাহত আছে। এখন ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিএনপির উদ্যোগে কোন কোন দল রয়েছে, এর বিস্তারিত জানা যায়নি।
অবশ্য বিএনপি ও জামায়াতের পৃথক তৎপরতাকে ‘ক্ষমতার রাজনীতিতে পাল্লা ভারী করার’ চেষ্টা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে যেসব দল ক্ষমতার রাজনীতি করে, তারা নিজেদের পাল্লাটা ভারী করার চেষ্টা করবে।