বুধবার, ১০ জুলাই ২০২৪
প্রথম পাতা » আমেরিকা | আর্ন্তজাতিক | পরিবেশ ও জলবায়ু | শিরোনাম | সাবলিড » নেটো সম্মেলনঃ যেসব বিষয় পশ্চিমা জোটের আলোচনায় প্রাধান্য পাবে
নেটো সম্মেলনঃ যেসব বিষয় পশ্চিমা জোটের আলোচনায় প্রাধান্য পাবে
বিবিসি২৪নিউজ,ফরিদা ইয়াসমিন (ওয়াশিংটন) যুক্তরাষ্ট্র থেকে: পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক জোট নর্থ আটকান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা নেটো এর আগে কখনো আকারে এত বড় ছিল না, কিন্তু তার ৭৫তম বার্ষিকীতে এই সংগঠন ভেতর এবং বাইরে থেকে তার অস্তিত্বের প্রতি হুমকির মুখে পড়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ, চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী চ্যালেঞ্জ এবং গাজায় ইসরায়েল-হামাস সংঘাত তো আছেই, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তাদের মিত্রদের নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার পূর্বসূরি ডনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে এই জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী সদস্যকে নেতৃত্ব দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ট্রাম্প নেটোর প্রতি আস্থাশীল নন।
বাইডেনের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো যখন দেশে এবং বিদেশে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, তখন ইউরোপীয় দেশগুলিতে বিশেষ করে ফ্রান্স এবং হাঙ্গেরিতে উগ্র ডানপন্থীদের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে তাদের নিজস্ব সমস্যাগুলির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ভিতকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
মঙ্গলবার (৯ জুন) ওয়াশিংটনে শুরু হওয়া তিনদিনের সম্মেলনে লক্ষ্য করার বিষয়:
টেলিভিশনে বাইডেন-ট্রাম্প বিতর্কের পর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে নেটো মহলেও উদ্বেগ বাড়ছে। ফটোঃ ২৭ জুন, ২০২৪।
টেলিভিশনে বাইডেন-ট্রাম্প বিতর্কের পর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে নেটো মহলেও উদ্বেগ বাড়ছে। ফটোঃ ২৭ জুন, ২০২৪।
বাইডেনের দিকে সবার দৃষ্টি
ট্রাম্পের সাথে ২৭ জুনের বিতর্কে তাঁর শোচনীয় পারফরম্যান্সের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে এবং তাঁর পুননির্বাচনী প্রচারণা ধরে রাখতে যখন বাইডেন হিমসিম খাচ্ছেন, তখন তিনি বলেছেন, এখনও তিনি নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। আর তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য নেটো শীর্ষ সম্মেলনে তার কর্মকাণ্ডের দিকে জনগণের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন- যদিও নেটো নেতারা স্বীকার করেছেন যে আমেরিকান নির্বাচনের উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই এবং প্রকাশ্যে মন্তব্য করার সম্ভাবনা কম।
“নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল নেটোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জোটের প্রায় সব রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানই একই রকম মনে করেন, যদিও তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান,” বলেন জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান-জার্মান ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট জেফ রাথকে।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ফিরে আসার সম্ভাবনা ইউরোপের অনেককে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তাদের আশঙ্কা যে ট্রাম্প নেটো বা ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কমাতে বা সেগুলো সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিতে পারেন।
“বাইডেনের নেটো সহযোগীরা এই ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য কিছুই করতে পারে না। তাই তারা এমন একটি প্রক্রিয়ার পর্যবেক্ষক হওয়ার অস্বস্তিকর অবস্থানে রয়েছে যা জোটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এর উপরে তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই,” বললেন রাথকে।
নেটোকে শক্তিশালী করা এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার কৃতিত্ব নেওয়া বাইডেন বলেন, তার আত্মবিশ্বাস ও যোগ্যতা সবার সামনে দৃশ্যম্যান হবে।
তবে কার্যত নেটোর প্রধান বা জোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে বাইডেন তার কাজটি সঠিক ভাবে করতে সক্ষম কিনা, এমন ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ প্রশমিত করার জন্য তাকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকতে হবে।
“ট্রাম্প কী করতে পারেন এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি কত দ্রুত করতে পারেন সেই অনিশ্চয়তা মানুষকে শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়েছে,” রাথকে বলেন। “তিনি জিতলে তা হবে নেটোর জন্য বড় রকমের ধাক্কা।”
তবে শুধু জো এখানে মুখ্য না
বাইডেনের দিকে মনোযোগ যতটাই থাকুক না কেন নেটোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও ৩১ জন নেতার মতামতের গুরুত্ব রয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কির স্টারমার নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের কয়েকদিন পর এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্বমঞ্চে তার প্রথম আবির্ভাব ঘটবে।
যদিও স্টারমার নেটো এবং ইউক্রেন উভয়ের জন্য অব্যাহত দৃঢ় সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছেন, তবে ডানপন্থী দলগুলির অগ্রগতি এবং গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে পশ্চিমা সমর্থনের বিরোধী বামপন্থী দলগুলির সমর্থন লাভ লন্ডনের প্রভাবকে হ্রাস করতে পারে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হল ফ্রান্সের অস্থিতিশীলতা, যেখানে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলি একজোট হয়ে উগ্র ডানপন্থীদের পরাজিত করেছে কিন্তু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করতে পারেনি। নেটো নিয়ে সন্দিহান উগ্র ডানপন্থী দল সংসদে তাদের আসন সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি করেছে।
তারপর আছে হাঙ্গেরি আর তুরস্ক। নেটোর এই দুই দেশ নতুন সদস্য ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের জোটে যোগ দেয়া অনেক দিন আটকে রেখেছিল। হাঙ্গেরির ভিক্টোর ওরবান গত সপ্তাহে পুতিনের সঙ্গে আলোচনার জন্য রাশিয়া সফর করে আতংক সৃষ্টি করেন, এবং তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ক্রেমলিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
নেটোর ভবিষ্যৎ
অনেক দিক থেকে, জোটকে আগে কখনই এতটা শক্তিশালী দেখায়নি। রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর নেটোতে ঐ দুই নতুন সদস্য যোগ হবার ফলে এর মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২। একই সময়ে, রাশিয়ার সীমান্তের কাছে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপীয় সদস্য— বাল্টিক রাষ্ট্রগুলি, পোল্যান্ড এবং চেক প্রজাতন্ত্র - ইউক্রেন এবং একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে নেটোর প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে।
কিন্তু নেটোর অবস্থান বেশ ভঙ্গুর। এর নীতিমালা সর্বসম্মতভাবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি হতে হয় এবং দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিস্তিশীলতা ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বাধাগ্রস্থ করে। নেটো নেতারা “ওপেন ডোর বা উন্মুক্ত দ্বার” নীতি পুনরায় ব্যক্ত করবেন বলে ধারনা করা হচ্ছে - যা হচ্ছে, যেকোন দেশ প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ করতে সক্ষম হলে সদস্যপদ পাবে। তবে এই সপ্তাহে ইউক্রেন তার প্রত্যাশিত আমন্ত্রণটি পাচ্ছে না।
“কোনো কোনো ক্ষেত্রে, নেটো শীর্ষ সম্মেলনের জন্য এটা সবচেয়ে ভালো সময় এবং সবচেয়ে খারাপ সময়েও হতে যাচ্ছে। ভাল সময়ে এই অর্থে যে জোট জানে এখানে ঘটনা কী,” বলেন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইউরোপ, রাশিয়া এবং ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক ম্যাক্স বার্গম্যান।
“তবে এটি সবচেয়ে খারাপ সময়ও - স্পষ্টতই কারণ, ইউক্রেন যুদ্ধ, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ, যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ,” তিনি বলেন।
ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় অভিযোগগুলির মধ্যে একটি নেটোর প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় নিয়ে এবং তিনি বারবার বলেছেন, যে যেসব দেশ প্রতিরক্ষা খাতে তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশ ব্যয় করার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে না যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশগুলিকে নিরাপত্তা দেবে না।
নেটো কর্মকর্তারা এই অঙ্গীকার পূরণকারী মিত্রদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাড়াতে পেরেছে। এই সংখ্যা এখন ২৩। ধারনা করা হচ্ছে যে শীর্ষ সম্মেলনের সময় আরও বেশ কয়েকটি দেশ বলবে যে তারা ঐ মান পূরণ করছে।
ইউক্রেনের প্রতি অব্যাহত সমর্থন
গত বছর অনেক নেটো মিত্র ইউক্রেনের সাথে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রাশিয়ার কাছ থেকে কিয়েভকে এবং নিজেদেরকেও রক্ষা করা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তার দীর্ঘমেয়াদী নিশ্চয়তার লক্ষ্যে চুক্তি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা অনুমোদনে কংগ্রেসের বিলম্বের সময়ে গত কয়েক মাসে রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সেগুলি কাটিয়ে ওঠা গেছে এবং এই সপ্তাহে একটি নতুন কয়েক শত হাজার কোটি ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
তবে ইউক্রেনের লক্ষ্য নেটোতে যোগদান। যা দেশটিকে এই জোটের আর্টিকেল ৫এর আওতায় সম্মিলিতভাবে নিরাপত্তা প্রদান করবে। এর মাধ্যমে আওতাভুক্ত কোন দেশে আক্রমণ হলে অন্যান্য সদস্যদের তার প্রতিরক্ষায় আসতে বাধ্য করে।
যখন লড়াই চলছে তখন সদস্যপদ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে, মিত্ররা ইউক্রেনকে সদস্যপদ পাওয়ার জন্য একটি “সেতু” হিসেবে উপস্থাপনের পরিকল্পনা করেছে যা পরবর্তী পদক্ষেপগুলিতে সাহায্য করবে।
ধারনা করা হচ্ছে যে এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশ নতুন করে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেবে। নেটোর বিদায়ী মহাসচিব ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ শুক্রবার বলেছেন, প্রতি বছর অনুদান নুন্যতম প্রায় ৪,৩০০ কোটি ডলার হওয়া উচিত।
চীনকে ভুলে গেলে চলবে না
নেটো মিত্ররা চীনের হুমকির দিকেও মনোনিবেশ করছে। এর মাঝে রয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সন্দেহের বীজ বপন করার লক্ষ্যে ক্রমাগত মিথ্যা প্রচারণা চালানো। নেটো দেশগুলো বারবার অভিযোগ করেছে যে চীন কিছু সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি বিক্রি করেছে যা ইউক্রেনে যুদ্ধ চালানোর জন্য রাশিয়াকে তার প্রতিরক্ষা শিল্প পুনর্নির্মাণ করতে সহায়তা করেছে।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সমালোচনা করেছে ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যাহত করার মত নীতি অনুসরণ করার জন্য। বেইজিং ইউরোপের দেশগুলোর সাথে আরও ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
দক্ষিণ চীন সাগর ও এর বাইরে চীনের হুমকি কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে আলোচনার জন্য পরপর তৃতীয় বছরের মতো অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তারা নেটো সম্মেলনে অংশ নিবেন।