শনিবার, ১ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » বিশেষ প্রতিবেদন | শিরোনাম » জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে যেসব বিষয় গুরুত্ব পেতে পারে
জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে যেসব বিষয় গুরুত্ব পেতে পারে
বিবিসি২৪নিউজ,কূটনৈতিক প্রতিবেদক ঢাকা: জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের প্রস্তুতিমূলক আলোচনার জন্য বেইজিং যাচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। আগামী সোমবার (৩ জুন) বেইজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েডংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। বৈঠকে সফরের দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি হচ্ছে সফরের মূল উপাদান (সাবস্টেনটিভ) এবং অন্যটি সফরসূচি অর্থাৎ প্রটোকল সংক্রান্ত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় চীনের সহায়তা চায়। অন্যদিকে বেইজিং চায় নিকট প্রতিবেশীর উন্নয়নে অবদান রাখার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করতে। বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুপক্ষের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে মিল খুঁজে বের করে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সফল করতে চায় বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানান। তবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি।
সফরের প্রেক্ষাপট
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত ১০ বছরে অন্তত চারবার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফর, ২০১৬ সালে শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর আবার বেইজিং সফর এবং ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় পুরোটাই চীনের পক্ষে। গত বছর চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ২১০০ কোটি ডলারের পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ রফতানি করেছে প্রায় ৭০ কোটি ডলারের সামগ্রী। বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীন এবং বাংলাদেশ যা রফতানি করে সেটির ৭০ শতাংশ ওই সুবিধার মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ চায় রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং ওইসব খাতে চীনা বিনিয়োগ, যা আবার চীনে রফতানি করা সম্ভব। বর্তমানে ছয় শতাধিক চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করে এবং এর মধ্যে প্রায় ২৫টির আঞ্চলিক প্রধান দফতর বাংলাদেশে।
২০১৬ সালে যে ২৭টি প্রকল্পের বিষয়ে দুইপক্ষ সম্মত হয়েছিল, তারমধ্যে ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, ছয়টির কাজ চলছে এবং ছয়টির বদলে অন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে আটটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যেমন- পদ্মা রেল লিংক, ইনফো সরকার, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংসহ টেলিকম ও বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প রয়েছে। ওই প্রকল্পগুলোতে মোট চীনা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৭৮০ কোটি ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হিসাবে, গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চীন থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৫৬০ কোটি ডলার। চীন অত্যন্ত দ্রুত বাংলাদেশে তাদের ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এসব প্রকল্পের ঋণের হার দুই থেকে তিন শতাংশ এবং পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে পরিশোধযোগ্য, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা। বাংলাদেশ চায় ঋণের হার কমাতে এবং পরিশোধযোগ্য সময় বাড়াতে।
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে মানুষে মানুষে যোগাযোগ আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেশি। একদিকে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এখন চীনে পড়তে যাচ্ছে। অন্যদিকে চীনের সংস্কৃতি বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কসফুসিয়াস সেন্টার স্থাপন বা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করাসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে বেইজিং। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, মিডিয়ার সদস্যসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নতুন ও উন্নত চীনকে দেখানো হচ্ছে। এটি আগেও হতো, কিন্তু এর মাত্রা এখন অনেক বেশি।
বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে চীন আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশ তা দেখায়নি। অন্যদিকে দুই দেশের মধ্যে প্রথম যে জয়েন্ট এক্সারসাইজ করার কথা ছিল, সেটি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরের সময়ে ওই দেশের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের বিষয়ে বাংলাদেশকে জানিয়েছিল। বাংলাদেশ প্রথম অবস্থায় ‘ধীরে চলো’ নীতি নিলেও এখন হয়তো চীনের উদ্যোগে সাড়া দিতে পারে। এছাড়া দুপক্ষ সম্মত হলে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নিয়েও আলোচনায় অগ্রগতি হতে পারে।
স্ট্র্যাটেজিক ফ্রিডম
পৃথিবীর প্রতিটি দেশ নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করে এবং বাংলাদেশ বা চীন এর ব্যতিক্রম নয়। এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, ‘চীনের ব্যবসায়িক ও কৌশলগত স্বার্থ আছে এবং তারা বাংলাদেশে কাজ করতে চায়।’
চীনের মতো বড় দেশের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘স্ট্র্যাটেজিক ফ্রিডম’ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে নেভিগেট করতে হবে।’
উল্লেখ্য, স্ট্র্যাটেজিক ফ্রিডম বলতে একটি দেশ কার সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক রাখবে এবং কীভাবে তার বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়ন করবে, সেটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকাকে বোঝায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ সবসময় একটি ভারসাম্য পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে, যা এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যেন অন্যদের অস্বস্তির কারণ না হয়, সে বিষয়ে সরকার অবশ্যই নজর রাখবে।’
সবার নজরে সফর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক প্রভাব ফেলে বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর।
এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘এই সফরকে অন্য দেশগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের একটি আদর্শগত যুদ্ধ (আইডোলজিক্যাল ব্যাটেল) আছে। এটি কোনও গোপন বিষয় নয়।’
প্রকল্প গ্রহণে চীনের আগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে, সেটির দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক, সামাজিক ও কৌশলগত লাভ বিবেচনা করা দরকার।’
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ সফর নিয়ে অন্যদের আগ্রহের বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে অন্য দেশগুলোর যে স্বার্থ, সেটি যেন ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে সবার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক।’
বাংলাদেশ ও চীন যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে সেগুলো নিয়ে অন্যদের উদ্বেগের কারণ হবে না বলে তিনি জানান।
কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
কূটনীতিতে অনেক সময় প্রকৃত ঘটনার থেকে অন্যরা বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে (পারসেপশন), সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ আসলে কী করছে এবং কী চাইছে সেটি নির্ভরযোগ্যভাবে বিভিন্ন পক্ষকে অবহিত করা অত্যন্ত দরকার।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছিল বাংলাদেশ। ওই সময়ে ঢাকা থেকে দিল্লি ও ওয়াশিংটনকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া হয়েছিল। বার্তা দুটি হচ্ছে– ওই সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ এমন কোনও কিছু করবে না, যেটি অন্য দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়।
এ বিষয়ে একমত পোষণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কূটনীতিতে যথাযথ কথা বলার (কমিউনিকেশন) কোনও বিকল্প নেই। বর্তমান জটিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে (ইফেক্টিভ) কমিউনিকেশন করা এখন সবচেয়ে বড় ডিপ্লোমেটিক চ্যালেঞ্জ।’