শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
প্রথম পাতা » প্রিয়দেশ | শিরোনাম | সাবলিড » মাতৃগর্ভের আগে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় গোপন রাখার উদ্যোগ
মাতৃগর্ভের আগে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় গোপন রাখার উদ্যোগ
বিবিসি২৪নিউজ,নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা: মাতৃগর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় যাতে প্রকাশ না করা হয় সে ব্যাপারে একটি গাইডলাইন তৈরি করে হাইকোর্টে জমা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ হাইকোর্ট অনুমোদন দিলে বাংলাদেশে মাতৃগর্ভের শিশুর লৈঙ্গিক পরিচয় প্রকাশ নিষিদ্ধ হবে৷ ২০২০ সালে হাইকোর্টে এক আইনজীবীর করা রিটের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই গাইডলাইন তৈরি করেছে৷ ওই গাইডলাইন মানা হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টারসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য বাধ্যতামূলক হবে৷ যারা এর অন্যথা করবেন, তারা ‘প্রফেশনাল এথিকস’ লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তির মুখোমুখি হবেন৷ গাইডলাইনে গর্ভের শিশুর পরিচয় প্রকাশ না করাকে প্রফেশনাল এথিকস হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল যে প্রফেশনাল এথিকসের কথা বলেছে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ শুধুমাত্র চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যগত কারণ ছাড়া আর কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা নন-মেডিকেল কারণে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না৷
১. কোনো ব্যক্তি, হাসপাতাল, ফার্টিলিটি সেন্টার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাবরেটরি কোনো লেখা বা চিহ্ন বা অন্য কোনো উপায়ে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করতে পারবে না৷
২. এ বিষয়ে কোনোরকম বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না৷
৩. সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো ডাক্তার, নার্স, পরিবার পরিকল্পনা কর্মী ও টেকনিশিয়ান কর্মীদেও গর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশের নেতিবাচক ফলাফল সম্পর্কে ট্রেনিং দেবে এবং নৈতিকতা ও পেশাগত আচরণ বিষয়ে ট্রেনিং দেবে৷
৪. হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ মেডিকেল সেন্টারগুলো এ সংক্রান্ত সব ধরনের টেস্টের ডাটা সংরক্ষণ রাখবে৷
৫. হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ মেডিকেল সেন্টারগুলো ডিজিটাল ও প্রিন্ট মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা এবং কন্যাশিশুর গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন বার্তা প্রচার করবে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, “আমরা আমাদের গাইডলাইন উচ্চ আদালতে জমা দিয়েছি৷ আদালত আমাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ডাকবেন৷ আদালত যদি এই গাইডলাইন অনুমোদন করেন, তাহলে আমরা কার্যকর করবো৷ আমরা বাস্তবায়ন করবো৷ তখন আমরা আপনাদের বিস্তারিত জানাতে পারবো৷”
নিজের সামনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় ব্যথিত হন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান৷ কয়েক বছর আগে তিনি নিজে যখন অন্তসত্তা, তখন ঢাকার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য যান৷ সেখানেই তাকে আরেক অন্তসত্তা কান্না ভীষণ ব্যথিত করে৷ ইশরাত হাসান জানান,” আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ওই নারী যখন জানতে পারেন তার গর্ভের সন্তান মেয়ে, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পরেন৷ আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার আরো দুইটি মেয়ে আছে৷ এবারো কন্যা সন্তান হলে তার বিপদ৷ এমনিতেই তিনি চাপের মুখে আছেন৷ এখন তাকে নির্যাতন করা হবে৷ বলছিলেন- এবার হয়তো বা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে৷”
“গ্রামে আমার অরেকটি অভিজ্ঞতা হলো, এক নারীর কন্যা সন্তান হওয়ায় তার স্বামী হাসপাতালের বিলই দিতে আসেননি৷ আমি একজন নারী আইনজীবী হওয়ায় এরকম আরো অনেক নারী আমার কাছে তাদের এই ধরনের নির্মম অভিজ্ঞতার কথা জানান৷ তারা যেহেতু নানা সামাজিক কারণ ও ভয়ে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে পারেন না, তাই তাদের হয়ে আমি হাইকোর্টে রিট করি,” বলেন এই আইনজীবী৷
তার কথা,”গর্ভের সন্তানের আগেই পরিচয় জানা এবং তা মেয়ে হলে মায়ের ওপর যে চাপ প্রয়োগ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তাতে মা শিশু উভয়ই ক্ষতির মুখে পড়েন৷ মাকে ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ৷ এর অবসান হওয়া জরুরি৷ গর্ভেও সন্তানের পারিচয় প্রকাশ লিঙ্গ বৈষম্যের সৃষ্টি করে৷”
তিনি আরো জানান, “বাংলাদেশে গর্ভপাত দণ্ডনীয় অপরাধ৷ কিন্তু আইনে ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি৷ এর সুযোগ নিয়ে গর্ভের সন্তান কন্যা নিশ্চিত হওয়ার পর গর্ভবতী মাকে গর্ভপাতে বাধ্য করার অভিযোগও আমি পেয়েছি৷”
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি রিট করেন এবং ওই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করে৷ এরপর রুলের ওপর শুনানি হয়৷ শুনানির ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ওই গাইডলাইন তৈরি করে৷ কমিটিতে চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা ছিলেন৷ গাইডলাইনটি ২৯ জানুয়ারি আদালতে দাখিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি ওই নীতিমালার ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান৷ আর রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাসগুপ্ত বলেন, “আদালতে শুনানির পর এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে৷ এখন এটা আদালতের এখতিয়ার৷”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তার গাইডলাইনে বলছে, “বাংলাদেশে ছেলে সন্তানের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকায় গর্ভেই লিঙ্গ চিহ্নিত হলে লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট হয়৷ এর ফলে নারী নির্যাতন বেড়ে যায়৷ গর্ভবতী মা ও গর্ভের কন্যা সন্তান অনাদর ও অবহেলার শিকার হয়৷”
“বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতসহ আরো অনেক দেশে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধ৷ এটা নির্ধারণ বাংলাদেশের সংবিধান ও মানবাধিকার বিরোধী৷”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম বলেন, “গর্ভেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করে প্রেফারেন্স ঠিক করা মানবাধিকার লঙ্ঘন৷ আর আমরা গবেষণায় দেখেছি, বাংলাদেশে ছেলে শিশুর প্রতি আগ্রহ বেশি৷ ফলে এভাবে হলে এক সময় নারীর সংখ্যা কমে যাবে৷ আর এখন যেহেতু ছোট পরিবারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, একটি সন্তানও নেন কোনো দম্পতি৷ সেক্ষেত্রে গর্ভেই লিঙ্গ পরিচয় জেনে ছেলে সন্তান নিলে তা আরো বৈষম্য তৈরি করবে৷ আর নারী কমে গেলে নারী পাচার বাড়বে৷”
তিনি জানান , “এই গাইডলাইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের৷ আর মেডিকেল রিজনে গর্ভের সন্তানের পরিচয় জানা যাবে৷ তবে সেটা আবেদনের ভিত্তিকে জাষ্টিফাই হতে হবে৷ ফার্টিলিটি সেন্টারে সন্তান নিতে গিয়ে কোনো দম্পতি যদি ছেলে ভ্রুণ পছন্দ করেন, তাহলে তো সেটাকে মেডিকেল রিজন বলা যাবে না৷”