বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » পরিবেশ ও জলবায়ু | সম্পাদকীয় » ইসরায়েল এমন এক জনগোষ্ঠীর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, যারা একেবারেই অসহায়
ইসরায়েল এমন এক জনগোষ্ঠীর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, যারা একেবারেই অসহায়
সম্পাদকীয়:- গত ৭ অক্টোবর ইয়াম কিপুর যুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকীতে হামাস ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা চালায়। এ হামলায় সহস্রাধিক মানুষ মারা যায়, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক; অপহরণ করা হয় দুই শতাধিক মানুষকে। অপ্রত্যাশিত এ হামলা ইসরায়েলের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, সভ্য বিশ্বে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। সে জন্য পরদিনই কংগ্রেস দ্ব্যর্থহীনভাবে হামাসের হামলার নিন্দা জানায়।
ট্র্যাজেডি হলো, এর পরই ইসরায়েলি বাহিনী গাজা ও তার আশপাশে নির্বিচারে হামলা চালায়। প্রায় তিন সপ্তাহে ইসরায়েলের অভিযানে হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক নিরীহ শিশু ও নারী রয়েছেন। ইসরায়েল তার রাষ্ট্রীয় সর্বশক্তি দিয়ে এমন এক জনগোষ্ঠীর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, যারা একেবারেই অসহায়। সামরিকভাবে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের অস্ত্র এমন শিশু, নারী ও পুরুষদের নিশানা বানাচ্ছে, যাদের হামাসের আক্রমণে কোনো হাত নেই। বরং তারা কয়েক দশক ধরে বৈষম্য ও দুর্দশা ভোগ করছে।
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তাদের হামলায় কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্য প্রাণ হারিয়েছে এবং আশপাশের পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে যে বিশাল মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলায় চিকিৎসাসেবা একেবারেই নগণ্য। পানি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া ফিলিস্তিনি জনগণের সম্মিলিত শাস্তির চেয়ে কম নয়। অবরুদ্ধ গাজায় বহির্বিশ্বের যে ত্রাণ ও সাহায্য যাচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। গাজার পরিস্থিতি শুধু অমানবিকই নয়, আন্তর্জাতিক আইনেও বেআইনি। গাজাবাসীর খুব কম অংশই এ সহিংসতা থেকে বাঁচতে পারছে। ছোট্ট আয়তনের জায়গায় গাজাবাসীর ঘনবসতিপূর্ণ বাস। তাদের যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। আর এখন, এমনকি অধিকৃত পশ্চিম তীরেও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে।
হামলা বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েলি কর্তাব্যক্তিরা গাজার বড় এলাকা ধ্বংস ও জনমানবহীন করার কথা বলেছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের ‘মনুষ্য জন্তু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ অবমাননাকর ভাষা বেদনাদায়ক এবং এমন কথা সে বংশধরদের থেকে আসছে, যারা নিজেরাই হলোকাস্ট বা ব্যাপক গণহত্যার শিকার।
মানবতা এখন কাঠগড়ায়। আমরা সম্মিলিতভাবে ইসরায়েলের ওপর হামলায় যেমন বেদনাহত; তেমনি এখন গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যা এবং নৃশংস হামলায়ও মর্মাহত। আমাদের সম্মিলিত বিবেক জাগা পর্যন্ত আর কত প্রাণ যাবে? ইসরায়েলি সরকার হামাসের আক্রমণের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের যেভাবে সমান অপরাধী করছে, সেটা গুরুতর ভুল। তারা হামাসকে ধ্বংস করার সংকল্পে গাজার সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার দীর্ঘ ইতিহাস বাদ দিলেও, কোন যুক্তিতে গোটা জনগোষ্ঠীকে গুটিকতক ব্যক্তির জন্য দায়ী করা যায়?
ফিলিস্তিনিরা যে জটিল সমস্যা মোকাবিলা করছে, তার মূলে রয়েছে বাইরের শক্তির পরিচালনায় সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরি সংকট। শুধু আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করা যেতে পারে। এটা আবারও বলা দরকার যে, এ আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের দাবি পূরণ করতে হবে। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের অধিকার হলেও কয়েক দশক ধরে তা অস্বীকার করা হয়েছে; অথচ অন্যদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ন্যায্যতা ছাড়া শান্তি আসতে পারে না। ইসরায়েল গাজাবাসীকে দেড় দেশকেরও অধিক সময় ধরে যেভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, তারা যেন ‘উন্মুক্ত কারাবন্দি’। সেখানকার ২০ লক্ষাধিক মানুষ ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও শরণার্থী শিবিরে বাস করছে। জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সহায়তায় ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ অব্যাহত রাখছে। তাদের আচরণে মনে হয়, তারা দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করতে চাইছে। শান্তি শুধু তখনই আসবে, যখন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্বে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ ফের শুরু হবে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মনে করে, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি উভয়েরই শান্তিতে বসবাসের অধিকার রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের মূল্যায়ন আমরা করি। এর অর্থ এই নয় যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনিদের যে ভূমি ছিল, সেখান থেকে তাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং বছরের পর বছর ধরে তাদের সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়ার বেদনাদায়ক স্মৃতি আমরা ভুলে যাব।
চলমান অবস্থায় বিশ্বকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক, প্রভাবশালী দেশগুলোর যখন যুদ্ধ বন্ধে সর্বাধিক প্রচেষ্টা করা উচিত, তখন তারা এক পক্ষকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিচ্ছে। সামরিক হামলা বন্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হওয়া দরকার এবং শক্তিশালী দেশগুলোর এগিয়া আসা উচিত। অন্যথায় যুদ্ধের এই চক্র অব্যাহত থাকবে এবং তা দীর্ঘ মেয়াদে এ অঞ্চলের মানুষদের শান্তিতে বসবাস করা কঠিন করে তুলবে।