বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৩
প্রথম পাতা » এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য | বিশেষ প্রতিবেদন | শিরোনাম | সাবলিড » ব্রিকসে বাংলাদেশকে কতটা সমর্থন করছে ভারত?
ব্রিকসে বাংলাদেশকে কতটা সমর্থন করছে ভারত?
বিবিসি২৪নিউজ,কূটনৈতিক প্রতিবেদক, ঢাকা: ব্রিকস’ অর্থনৈতিক জোটের শীর্ষ সম্মেলন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে চলছে , যেখানে জোটের সম্প্রসারণ ইস্যুটি একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। আয়োজক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষ আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রাতেই (মঙ্গলবার) জোহানেসবার্গে গিয়ে পৌঁছেছেন। জোটের অন্যতম শরিক ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সেখানেই রয়েছেন। কিন্তু ব্রিকসে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব নিয়ে ভারত ঠিক কী অবস্থান নিচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট করা হয়নি। জোটের নতুন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রার্থিতাকে ভারত সমর্থন করছে কিনা, সোমবার দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলনেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াটরা এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন।
তবে দিল্লিতে ভারতের একাধিক পর্যবেক্ষক ও পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ভারত যে বাংলাদেশের প্রার্থিতার বিরোধিতা করছে বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। কিন্তু ব্রিকসের সম্প্রসারণের নামে চীন এই জোটে নিজেদের পাল্লাভারী করার চেষ্টা চালাচ্ছে– এই আশঙ্কাটাই ভারতকে কিছুটা সতর্ক ও সন্দিগ্ধ রেখেছে।
অর্থাৎ, নতুন সদস্যদের নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত যে বেশ সাবধানে পা ফেলতে চাইছে সেটা ব্রিকসে যোগদানে ইচ্ছুক সব নতুন দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য– বাংলাদেশের জন্য আলাদাভাবে কিছু নয়।
আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত গত সপ্তাহেই ঘোষণা করেছে, তারা মোটেই ব্রিকস সম্প্রসারণের বিরোধী নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেছেন, ‘বরং আমরা নতুন সদস্য নেওয়ার বিষয়টিকে খোলা মনে, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখছি। কিন্তু এই যোগদানের ক্রাইটেরিয়া বা মাপকাঠি কী হবে, সেটা নিয়ে আগে আলোচনা করা দরকার।’
দিল্লিতে স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (ওআরএফ) ফরেন পলিসি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থও মনে করেন, ব্রিকসে ভারতের সমস্যাটা জোটের আর এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চীনকে নিয়ে, বাংলাদেশকে নিয়ে নয়। তিনি বলছিলেন, ‘চীন আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই ব্রিকসকে একটা পাশ্চাত্যবিরোধী ওরিয়েন্টেশন দিতে চাইছে। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে কোণঠাসা রাশিয়াও সেই সুরেই সুর মেলাচ্ছে। কিন্তু সঙ্গত কারণেই ভারত বা ব্রাজিলের পক্ষে তাতে তাল দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ভারত নিজে কোয়াডের সদস্য (অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত— এই চার দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক জোট) সেটাও মনে রাখতে হবে। তাই দিল্লি দুটোর মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখেই চলতে চেষ্টা করবে।’
দেশটির সমবায় শাসন ও ঐতিহ্য বিষয়ক মন্ত্রী পার্ক টাউ এবং সেদেশে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নূর-ই হেলাল সাইফুর রহমান
অধ্যাপক পন্থ আরও মনে করেন, ব্রিকস জোটে যাবতীয় সিদ্ধান্ত যেহেতু সদস্যদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়, তাই কোনও নতুন দেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে বর্তমান পাঁচ সদস্য একমত না হলে তাদের নামে সিলমোহর পড়াটা কঠিন।
“এদিক থেকে আমি বলবো পাঁচটি দেশ নতুন সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে ‘ফ্রন্টরানার’, বা দৌড়ে এগিয়ে আছে – আর এগুলো হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, মিশর ও আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশ এখানে ঠিক এর পরের সারিতে আসবে বলেই আমার ধারণা” আরও জানাচ্ছেন তিনি।
দিল্লির আর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন সিস্টেমের (আরআইএস) ফরেন ডেভেলপিং কান্ট্রিজের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে-র কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশকে ভারত অবশ্যই স্বাগত জানাচ্ছে।
তিনি এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘মনে রাখতে হবে ২০২১ সালেই কিন্তু বাংলাদেশ ব্রিকস ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যোগ দিয়েছে, আর তাতে ভারতের সোৎসাহ সমর্থন ছিল। এর পরের ধাপটাই হলো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ব্রিকসে যোগদান। ২০২৬ থেকেই যেহেতু তারা এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হবে, তাই নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টায় বাংলাদেশের এই পদক্ষেপটা খুব দরকার। আর ভারত সেটা অ্যাকনলেজও করে।’
তাছাড়া যেহেতু চীন, ভারত ও রাশিয়া – এই তিনটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুব শক্তিশালী, তাই ব্রিকসে তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা নেহাত সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করছেন ড. প্রবীর দে।
‘আমি তো বলবো ভারত অবশ্যই চাইছে বাংলাদেশ ব্রিকসে আসুক। কারণ তাতে তাদের নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্কও শক্তিশালী হবে। কিন্তু অন্য আরও নানা কারণে ভারত এটা নিয়ে তাড়াহুড়ো চাইছে না। বরং চাইছে সব নবাগতর জন্য নিয়মকানুনটা আগে আঁটসাঁট করে তারপর এই প্রক্রিয়াটা শুরু করতে’ আরও বলছিলেন তিনি।
ভারতের জাতীয় দৈনিক ‘দ্য হিন্দুস্থান টাইমসে’র কূটনৈতিক সংবাদদাতা রেজাউল এইচ লস্করও বলছিলেন, ‘ব্রিকসের সদস্য হতে বাংলাদেশের আবেদনকে ভারত মোটেই বাধা দিচ্ছে না, বরং প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থনই করছে। কিন্তু তাদের প্রধান দুশ্চিন্তা হল, ব্রিকস যেন চীনকেন্দ্রিক একটা জোট না হয়ে উঠে। আর তাই পাশাপাশি সেই উদ্বেগের জায়গাটাও অ্যাড্রেস করতে চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বস্তুত যে প্রায় ৪০টির মতো দেশ ব্রিকসে যোগদান করতে চেয়ে লিখিত আবেদন করেছে বা মৌখিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ সেই বিরল দেশগুলোর অন্যতম – যাদের সঙ্গে চীন, ভারত ও রাশিয়া সবারই সম্পর্ক বেশ ভালো। বেইজিং, দিল্লি ও মস্কোর সঙ্গে এই চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রাখতে পারার ফলে ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদানের পথ প্রশস্ত হতে পারে– এমনটাও অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন।
ব্রিকসের সম্প্রসারণ নিয়ে ভারত ও ব্রাজিলের মনোভাবে যে কিছুটা সংশয় আছে এটা এতদিনে সবারই জানা। ঘটনাচক্রে এই দুই দেশই আবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পাওয়ার ব্যাপারে প্রবলভাবে আগ্রহী। অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, যেসব দেশ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবিত সংস্কারে সমর্থন জানাবে (অর্থাৎ ভারত ও ব্রাজিলের স্থায়ী সদস্যপদে সায় দেবে) – তাদের আবেদন নিয়ে ব্রিকসেও ভারত ও ব্রাজিল পাল্টা সক্রিয়তা দেখাবে। বৈশ্বিক কূটনীতির বহু প্ল্যাটফর্মই এরকম ‘কুইড প্রো কো’ বা লেনদেনের ভিত্তিতে চলে, ব্রিকসও তার ব্যতিক্রম নয়।