বিবিসি২৪নিউজ,যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি : যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি ট্রাফিক পুলিশের যৌন হয়রানি মামলা অবশেষে সাড়ে তিন কোটি টাকায় নিষ্পত্তি করা হয়েছে। গত ৮ আগষ্ট সিদ্ধান্ত মোতাবেক যৌন হয়রানির শিকার ও মামলার বাদীনি গেইল রামরুপকে ৩ লাখ ১৫ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ দেবার বাংলাদেশি ট্রাফিফ পুলিশ সাইদ রহিম দুদু’র সাথে চুক্তি করা হয়। দুদু নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ট্রাফিক ইনফোর্সমেন্ট এজেন্ট পদে কর্মরত অবস্থায় গেইল রামরুপ তার দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রায় ২৬০০ সদস্য বিশিষ্ট ইউনিয়ন সিডব্লিউএ লোকাল-১১৮২-র সভাপতি ছিলেন সাইদ রহিম দুদু।
যৌন হয়রানির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলে নিউ ইয়র্ক ট্রাফিক ইউনিয়নের সভাপতি সাঈদ রহিম দুদু। অফিসের মহিলা সেক্রেটারি ৬ লাখ ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করেন তার বিরুদ্ধে। যৌন নিপীড়নের অভিযোগে নিউ ইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক এজেন্ট ইউনিয়নের সভাপতি বাংলাদেশি বংশোদভূত সভাপতি সাঈদ রহিমকে তার দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করে ইউনিয়নের দায়িত্বগ্রহণ করেন ওয়াশিংটনের সংগঠনের জাতীয় কমিটি। কমিউনিকেশন ওয়াকারকার্স অব আমেরিকা লোকাল ১১৮২-র শীর্ষ পদ হারানোর সাঈদ রহিম সাধারন ট্রাফিফ এজেন্টের মতো সার্বক্ষণিক ঘুরে ঘুরে টিকিট দেয়ার দায়িত্বপালন করেন। ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর সাঈদ রহিমের বিরুদ্ধে উক্ত চাঞ্চল্যকর সংবাদটি প্রকাশ করেন নিউ ইয়র্কের দৈনিক ডেইইলি নিউজ।
ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট সাঈদ রহিম দুদু (৬৭)-র বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে ৬ লাখ ডলার ক্ষতিপুরণ দাবি করে ম্যানহাটন সুপ্রিম কোর্টে ২০১৯ সালের ১৫ মে মামলা করেছিলেন অফিস সেক্রেটারি গেইল রামরুপ। মামলার নং- ১৬৭০৪৭/২০১৯. (The Sexual Harassment case at NYS Supreme Court of Manhattan. NSCEF Index # 157047/2019. Filed on 5/15/2019), যেহেতু সকল অপরাধ ইউনিয়নে কর্মরত সময়ের মধ্যে হয়েছে তাই উক্ত মামলায় ইউনিয়নকে ৫ লাখ ডলার এবং রহিমকে ১ লাখ ডলার ক্ষতিপুরণ দাবি করে মামলা হয়। রামরুপের ফোনে যত প্রমানাদি ছিলো তিনি তা আদালতে জমা দেন। সেসব প্রমানাদি দেখে আদালতের কাছে উক্ত মামলার গুরুত্ব ও সত্যতা প্রমানিত হয়। তখন সবাই ধারনা করেছিলেন এ সকল প্রমানাদির জন্য সাঈদ রহিম দুদুর জেল হতে পারে। একজন সিটি এমপ্লয়ী যদি আদালতে দোষী প্রমানিত হন তাহলে তার জেল হবে, চাকুরী চলে যাবে, অবসর জীবনেরভাতাও পাবেন না, ডিপার্টমেন্টের সুনাম ক্ষুন্ন হবে, তার সংসার ও সামাজিক সম্মান ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এসব মানবিক কারণে আদালতের বাইরে ক্ষতিপুরন দিয়ে মামলাটি সেটেল্ড করতে আদালতের আদেশ পাওয়ার জন্য ২০১৯ সাল থেকে সাঈদ রহিমের উকিল বারবার আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের কাছে। দীর্ঘ ৩ বছর পর গত ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিচারক ডেভিড কোহেন এক আদেশে সেটেল্ড করার অনুমতি দেন। আদালতের আদেশ পেয়েই ১ মাস পর সুচতুর রহিম নিজের টাকা বাঁচানোর জন্য গত জানুয়ারি ১১, ২০২৩ ব্যাংক্রাপ্টসি করেন। এজন্য এই মামলার ক্ষতিপুরণ সহ অনেকগুলো ব্যাক্তিগত লোন এবং ক্রেডিট কার্ডের টাকা পরিশোধ না করার আইনগত সুযোগ পেয়ে যান তিনি। যেমনঃ ওয়েব ব্যাংকের পাওনা ৩১ হাজার ডলার, প্রসপার ফান্ডিংয়ের ৬ হাজার ডলার, মেহেলা ব্যাংকের ৭ হাজার ডলার, নিজের বাড়িওয়ালার ক্ষতিপুরণ ৪ হাজার ডলারসহ অনেক গুলো। এছাড়া তার বিরুদ্ধে চলমান মামলা ভেলোসিটি ইনভেষ্টমেন্টের মামলা, গেইল রামরুপের মামলা, ক্যাভেলরি এসপিভি মামলা, জেপি মরগান মামলা, চেজ ব্যাংকের মামলা, স্টানডার্ড কনজুমার ব্যাংকের মামলা, বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ডের মামলা এবং লোনের অপরিশোধিত টাকা। যেগুলো তিনি আর পরিশোধ করবেন না।
২০১৯ সালে এ মামলাটি হবার পর সভাপতি রহিমকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুনদায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন ষ্টাফ রিপ্রেজেনটেটিভ রিকি মরিসন। এই ইউনিয়নে চলমান অর্থনৈতিক অনিয়ম বিষয়ে ফরেনসিক অডিট করান রিকি মরিসন। সেখানেতারা ৩৭টি অনিয়ম পায়। এরপর রহিম নিজেকে নির্দোষ দাবী করে ন্যাশনালকমিটির কাছে বিচার দেয়।
সিডব্লিউ এ-র অডিট এবং তদন্তে রহিমের বিরুদ্ধে ৩৭টি সুনির্দিষ্টঅপরাধ পাওয়া যায়। এরপর গত ৬ মে, ২০২০ তারিখে সিডব্লিউএ-রপ্রেসিডেন্সিয়াল মিটিংয়ে এই অভিযোগ গুলো আলোচনা করে রহিমকে দোষী প্রমান করে। কিন্তু সাংগঠনিক নিয়মে ঐদিন থেকে ৬০ দিনের মধ্যে কেউ সময়মতো চার্জ এনে বিচার না চাওয়ায় গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার প্রার্থীতাঅযোগ্য করা সম্ভব হয়নি।
সাঈদ রহিমের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রচারণায় জয়ী হলে ইউনিয়ন থেকে গাড়ি না নেবার ওয়াদা করেও তা রক্ষা করেননি। উল্টো ২ লাখ ডলারের ল্যান্ড রোভার গাড়ী নিয়েছেন, কিন্তু ইউনিয়নের পয়সায় নেয়া গাড়িটি নিজের নামে না নিয়ে তার স্ত্রীর নামে নেন। অথচ তার স্ত্রী এই ইউনিয়নের সদস্য নন। গাড়ি ব্যবহারের জন্য ইউনিয়নের অর্থে পেট্রল কিনলেও নিয়মিত চলাচলের জন্য ইউনিয়নের অর্থেই সাবওয়ের মাসিক কার্ডও নিতেন তিনি। এছাড়া তদন্তে সবমিলিয়ে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের ৩৭টি অভিযোগ পেয়েছিলো সংগঠনেরজাতীয় কমিটি। সেসবের জন্য তিনি বিশ্বস্থতা হারিয়েছেন সবার কাছ থেকে।
একথা সবাই জানেন যে, নির্বাচনে বিজয়ের পর শপথ নেবার আগে কোন কর্মকর্তা তার পদ পদবী ব্যবহার করে কোন রকম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারেন না। করলে তা অবৈধ বা অকার্যকর বলে গন্য হয়। লোকাল-১১৮২-র ইউনিয়ন লীডাররা এ বছর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তারা শপথ গ্রহন করেন দুই মাস পর ১৩ এপ্রিল,২০২৩। শপথের আগে তাদের কোন বোর্ড মিটিং হবার আইনও নেই এবং তারা কোন মিটিং করেননি। অথচ অজানা উদ্দেশ্যে চলমান যৌন হয়রানির মামলার সকল দায়িত্ব রিকি মরিসনের উপর দিয়ে দেন রহিম। সেভাবে উকিল দিয়ে ড্রাফট (সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট এ্যান্ড জেনারেল রিলিজ) করে এনে নব নির্বাচিত সবার স্বাক্ষরও নিয়ে নেয় ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। সেই চুক্তি মোতাবেক রিকি মরিসন যখন যে খরচ চেয়েছেন আমাদের ইউনিয়ন তখনই সেই টাকা দিয়ে দিয়েছে। ক্ষুব্দ হয়ে যে মেয়েটি রহিমের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তিনি এবং তার উকিল সবমিলিয়ে পেলেন ৩ লাখ ১৫ হাজার ডলার। আর মামলাটি শুধু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনানী দেরী করানোর জন্য ইউনিয়নের উকিল নিয়ে গেলেন ৪ লাখ ১৯ হাজার ডলার। এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? এমনভাবে সদস্যদের অর্থ অপচয় করার উদ্দেশ্যে নবনির্বাচিত কর্মকর্তাদের শপথ গ্রহনের ২ মাস পূর্বে অগ্রিম একটা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়া হয় এবং পরবর্তী কোন মিটিংয়ে এমনকি সাধারন সভাতেও তারা এই চুক্তিনামা অনুমোদন করেনি। এই চুক্তিনামা একদম অবৈধ। এভাবে সদস্যদের টাকা ধ্বংশ করার জন্য রহিমের উপর সদস্যরা খেপে উঠেছেন বলে জানা গেছে।
এ অবস্থায় সদস্যদেরকে শায়েস্থা করতে বেতন বৃদ্ধি বিষয়ক আসন্ন কন্ট্রাক্ট পাশ করাতে গড়িমসি শুরু করেছেন সাঈদ রহিম। ট্রাফিক এজেন্ট লেবেল-৩ এবং লেবেল-৪ এর ইউনিয়ন লোকাল-৯৮৩ সীদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কন্ট্রাক্ট সাইন করবে। সকল ইউনিয়নের মতো সিটি তাদেরকেও যা অফার করেছিলো সেগুলোর সাথে তারা কিছু বেশী সুবিধা দাবী করে, এবং সিটি সেটা মেনে নিয়েছে। এজন্য তারা কন্ট্রাক্ট সাইন করতে যাচ্ছে। কিন্তু অজানা কারনে এ বছরের জুন ও জুলাই মাসের দুটো মিটিংয়ে না যেয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন পিছিয়ে দিয়েছেন রহিম। এছাড়া সদস্যদের পক্ষে সিটির কাছে রহিম যে আসলেই কি কিনেছেন তা সদস্যদের কাছে পুরোটাই গোপন রেখেছেন। এসব বিষয়ে সদস্যরা ভীষনক্ষুব্ধ। তারা রহিমের অপসারনের দাবীতে অনাস্থা দাবী তোলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশ থেকে নিউ ইয়র্কে আসেন সাঈদ রহিম দুদু। দেশ থেকে কেমিস্ট্রী ও আইন শাস্ত্রে ডিগ্রী নিয়ে এখানে এসে ২০০৫ সালে নিউ ইয়র্ক ট্রাফিক বিভাগে চাকুরীতে যোগ দেন তিনি। দুইবার সুপারভাইজার পদে পদোন্নতির সুযোগ এলেও ইউনিয়নের অর্থচুরীর মায়ায় আটকে যান।
সম্প্রতি আরো একটি মেয়ের নাম পুরো ডিপার্টমেন্টে আলোচিত হচ্ছে। মিস গেইল রামরুপ চলে যাবার পর মিস সুজান ভিক্টোর নামে এক তরুনীকে অফিস সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেয়া হয় লোকাল-১১৮২-র অফিসে। এবছরের নির্বাচনের পর অদ্যাবধি মেয়েটি অফিসে বসেন না। অজানা ফেভারিটজমের কারনে তিনি দাপটের সাথে নিজ বাসায় বসে অফিস করেন এবং সভাপতি সাঈদ রহিমের নির্দেশ মোতাবেক তাকে বেতন দেয়া হয় নিয়মিত। অফিসে বসবেন না, সদস্যদের সেবা দেবেন না, আবার ঘরে বসে বসে সদস্যদের ডিউজের ফান্ড থেকে বেতন নেবেন এটা কেমন কথা? এমন অনেক অনিয়মের সাথে জড়িয়ে আছে সাঈদ রহিমের নাম।
যৌন হয়রানীর মত ঘটনায় জড়িয়ে মামলা মোকাবিলা করছেন যখন সাঈদরহিম তখন তাকে নিয়ে তার ডিপার্টমেন্টের স্বদেশী সহকর্মীরা যারা এক সময়েতাকে নিয়ে গর্ব বোধ করতেন তারা এখন লজ্জিত বোধ করছেন। তার কারনে যে ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশীদের বিরাট সুনাম ছিলো তাতে কিছুটা হলেও কালিমা লেপে দিয়ে গেলেন সাঈদ রহিম।