মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট ২০২৩
প্রথম পাতা » জাতীয় | পরিবেশ ও জলবায়ু | প্রিয়দেশ | বিশেষ প্রতিবেদন | রাজনীতি | শিরোনাম » বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কিত বেদনা-বিধুর এক দিন
বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কিত বেদনা-বিধুর এক দিন
বিবিসি২৪নিউজ, এমডি জালাল, ঢাকা: আজ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কলঙ্কিত বেদনাবিধুর এক দিন। ১৯৭৫ সালের এ দিনে প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের জঘন্যতম কলঙ্কের দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী।
১৯৭৫ সালের এই দিনে ইতিহাসের বর্বরোচিত ও মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সপরিবারে হত্যা করা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালি হারায় তার আরাধ্য পুরুষ ও ইতিহাসের মহানায়ককে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃংশসভাবে হত্যাযজ্ঞের নেপথ্য কুশীলবদের বিচার নিশ্চিত করতে কমিশন গঠনের আইনের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কমিশন গঠনের বিষয়ে আইনের খসড়া আমরা দাঁড় করিয়েছি। কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা এটা উপস্থাপন করব। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলে সেটি জাতীয় সংসদে তোলা হবে।’
এছাড়া বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ৫ খুনিকে দেশে ফেরানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলেও জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি এ হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের চিহ্নিত করার প্রশ্নে তদন্ত কমিশন গঠনের বিষয়টি সরকারি নীতিনির্ধারণী মহল থেকে বছরের পর বছর ঘোষণা করা হলেও তা এখনও বাস্তব রূপ পায়নি। দীর্ঘ ৪৮ বছর পরও হয়নি এই কমিশন। ইতিহাসের কলঙ্কিত ওই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কারা, কীভাবে জড়িত ছিলেন- এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিও ওঠে বারবার। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারাও ইতোপূর্বে কমিশন গঠনে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তবে তা এখনও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
একদল সেনা কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ড ঘটালেও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন।
খুনিদের বিচার হলেও নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে ২০২০ সালে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি প্রস্তাব দেয়। তার ধারাবাহিকতায় এই কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেয় আইন মন্ত্রণালয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আনিসুল হক বলেন, ‘১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে বদলে দেওয়ার জন্য যে কলঙ্কিত চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল, যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, তার সঙ্গে কারা কারা জড়িত ছিল, সেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোই হবে কমিশনের মূল উদ্দেশ্য।’
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় ১৯৮০ সালে, যুক্তরাজ্যে। আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়ায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ও আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী আইনবিদ অবরি রোজসহ চার জন মিলে এ কমিশন গঠন করেছিলেন। যদিও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার অনুসন্ধানের কাজে ওই কমিশনকে বাংলাদেশে আসার ভিসা দেয়নি।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার আত্মস্বীকৃত খুনিরা ছাড়া পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিচারে কমিশন গঠনের দাবির মুখে ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ আয়োজিত বিশেষ ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে কমিশন গঠনের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচারিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে।
ওই সময় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সাবেক সেনা সদস্যদের বিচার হলেও এর পেছনের রাজনীতি এবং ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তদন্ত হয়নি। মূলত সেটা খুঁজতেই তদন্ত কমিশন হবে।’
গত বছর আগস্টে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছিল। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, কমিশনের খসড়া প্রস্তুত হচ্ছে। এই রূপরেখা ও কার্যাবলি কী হবে এবং কাদের দ্বারা এই কমিশন গঠিত হবে- সেসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ৪৮ বছর পেরিয়ে গেছে। মামলার রায়ও হয়েছে এক যুগের বেশি সময় আগে। কিন্তু আত্মস্বীকৃত ১২ খুনির মধ্যে ৬ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হলেও এখনো ৫ খুনি বিদেশে পলাতক। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকরের জন্য কয়েক বছর ধরেই কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। ইন্টারপোলের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অবস্থান প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তারা দুই খুনির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত। অন্য তিনজনের অবস্থান জানতে প্রবাসীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে সরকারকে জানালে তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে বলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন আজিজ পাশা। বাকি পাঁচজনের মধ্যে এম এ রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং এবিএমএইচ নূর চৌধুরী কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এ ছাড়া রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান, খন্দকার আব্দুর রশিদ এবং শরিফুল হক ডালিমের অবস্থান নিশ্চিত হতে সরকার কাজ করছে।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, খন্দকার আব্দুর রশিদ লিবিয়া, পাকিস্তান বা আফ্রিকার একটি দেশে এবং রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ইউরোপের একটি দেশে ও শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান, লিবিয়া বা স্পেনে রয়েছেন। তারা মাঝেমধ্যেই অবস্থান পরিবর্তন করেন। তারা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় যাতায়াত করছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
এদিকে তৎকালীন এক সেনা কর্মকর্তার দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে নয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আরও দুটি বাড়ি থেকে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে উদ্ধার করা হয় অন্যদের লাশ। বঙ্গবন্ধুকে তার জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করা হয়। ১৭ জনকে কবর দেয়া হয় বনানী গোরস্থানে।
এই কবরস্থানের সাত নম্বর সারিতে আছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ নাসের, শেখ কামাল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজি জামাল, শিশু শেখ রাসেল, শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, গৃহপরিচারিকা, অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচজন এবং ১০ বছর বয়সী এক বালিকা, তার পরিচয়ও পাওয়া যায়নি।
এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ পৃথক বাণী দিয়েছেন। এসব বাণীতে ১৫ আগস্টে শাহাদাতবরণকারী জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্যদের অম্লান স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তারা।
আজকের কর্মসূচি
দিবসটি উপলক্ষে আজ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রয়েছে। বিদেশের বাংলাদেশ মিশনগুলোতেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। পোস্টার মুদ্রণ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রোথ সেন্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাতীয় শোক দিবসের পোস্টার স্থাপন ও এলইডি বোর্ডের মাধ্যমে প্রচার করা হবে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ সূর্য উদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সব স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন।
সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ঐতিহাসিক ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন।
সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, দোয়া মাহফিল ও মোনাজাত।
সকাল ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, দোয়া মাহফিল শেষে মোনাজাত করা হবে। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করবেন।
দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ মানুষদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও গণভোজের আয়োজন করা হয়েছে। বাদ আসর মহিলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
একই দিন বাদ জোহর কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে বেলা ১১টায় মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে বিশেষ প্রার্থনার আওয়াজন করা হয়েছে।
সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডাস্থ আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং বেলা ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা করবে।